শান্তনু দত্ত চৌধুরী, কলকাতা: বেশ কিছুদিন ধরে একটি শক্তি তাদের হীন সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য নেতাজী সুভাষচন্দ্রকে সামনে রেখে সাম্প্রদায়িক প্রচার চালাচ্ছে।তাদের ভাবটা এরকম যে নেতাজির জাতীয়তাবাদী ভাবধারা ছিল হিন্দুত্ববাদ প্রসূত।নেতাজি হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন ইত্যাদি হাস্যকর মিথ্যা গালগল্প।
প্রকৃত সত্য হল নেতাজি সুভাষ আজীবন সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে নিরলস যোদ্ধা ছিলেন। ভারতীয়দের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভাজন ঘটানোর জন্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলির ঘৃণ্য প্রচেষ্টা সম্পর্কে তিনি ছিলেন সদাসতর্ক।মেধাবী ছাত্র সুভাষচন্দ্র ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় সফল হওয়া সত্বেও হেলায় সেই লোভনীয় চাকুরী পরিত্যাগ করেন।তিনি দেশসেবার ব্রত গ্রহণ করেন ও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের নেতৃত্বে রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগ দেন।১৯২১ – ১৯২২ এর অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে তিনি প্রথম কারাবরণ করেন।দেশবন্ধু ছিলেন হিন্দু – মুসলিম ঐক্যের মূর্ত প্রতীক।সুভাষচন্দ্র ছিলেন তাঁর মানস সন্তান।দেশবন্ধু কলকাতা শহরের প্রথম ভারতীয় মেয়র।তিনি তরুণ সুভাষকে কলকাতা পৌরসভার চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার পদে নিয়োগ করেন।দেশবন্ধু পশ্চাদপদ মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য পৌরসভার বিভিন্ন পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে সংরক্ষণের ব্যাবস্থা করেন।তিনি বাংলায় হিন্দু ও মুসলমান এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে অভূতপূর্ব ঐক্য স্থাপন করেছিলেন। ইতিহাসে এই ঐক্যকে ‘ বেঙ্গল প্যাক্ট’ বলে।১৯২৩ সালে বঙ্গীয় আইনসভার নির্বাচনে দেশবন্ধুর নেতৃত্বে নবগঠিত স্বরাজ্য দল বিপুলভাবে জয়লাভ করে।এমনকী অধিকাংশ সংখ্যালঘু আসনেও মুসলিম লীগ দেশবন্ধুর দলের কাছে পরাস্ত হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৩০ সালে যখন সুভাষচন্দ্র মেয়র হন তখন তিনিও দেশবন্ধুর নীতি অনুসরণ করেন।
ভারতের ইতিহাস সম্পর্কে সুভাষচন্দ্র ছিলেন প্রগাঢ় জ্ঞানের অধিকারী।তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ Indian Struggle (ভারতের মুক্তি সংগ্রাম) এর ভূমিকা
‘ ভারতীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থার পটভূমি’ তে প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাস সম্পর্কে তিনি বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করেছেন। সম্রাট অশোকের ( খ্রিস্টপূর্ব ২৬৮ – ২৩২ অব্দে )এবং সম্রাট সমুদ্র গুপ্তের ( খ্রিস্টীয় ৩৩০ – ৩৭৫ অব্দে) রাজত্বে ভারতবর্ষ একটি কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে আসে ও সমৃদ্ধির শীর্ষে আরোহণ করে বলে তিনি বর্ণনা করেছেন।এই দুই নৃপতির শাসনের মধ্যবর্তী ও পরবর্তী পর্যায়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কিছু উল্লেখযোগ্য নৃপতি রাজত্ব করলেও প্রাচীন যুগে সমগ্র ভারত আর কখনও কোনও একটি সুসংহত কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে আসেনি।ভারতবর্ষের বুকে ইসলাম ধর্মাবলম্বী শাসকদের অভিযান শুরু হয় খ্রিস্টীয় দশম শতকে।নেতাজি লিখেছেন ” কিন্তু দেশব্যাপী ঐক্য স্থাপন এবং সর্বব্যাপী অগ্রগতির কৃতিত্ব মুঘল বাদশাহদের জন্যই সঞ্চিত ছিল।ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতকে, মুঘল সম্রাটদের শাসনকালে,ভারতবর্ষ আরও একবার অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছায়।তাঁদের মধ্যে সর্বোত্তম ছিলেন আকবর ; যিনি ষোড়শ শতাব্দীর শেষার্ধে রাজত্ব করেন।দেশে রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠাই আকবরের প্রধান কীর্তি ছিল না, বোধহয় অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ছিল পুরাতনের সঙ্গে সংস্কৃতির নতুন ভাবধারার মিলন ঘটানোর জন্য একটি নতুন সাংস্কৃতিক সমন্বয় সাধন ও নতুন সংস্কৃতির সৃষ্টি। তিনি যে সাম্রাজ্যশাসন যন্ত্র গঠন করেছিলেন তাও হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের ঐকান্তিক সহযোগিতাকে ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছিল।মুঘলদের শেষ প্রধান সম্রাট ছিলেন আওরঙ্গজেব।১৭০৭ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয় এবং তাঁর মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে সাম্রাজ্যের ভাঙন ধরে “।নেতাজি সমসময়ে পশ্চিম মধ্য ভারতে ছত্রপতি শিবাজির নেতৃত্বে মারাঠা শক্তির উত্থানের কথা উল্লেখ করেছেন।কিন্তু তিনি বলেছেন অষ্টাদশ শতাব্দীর পর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে এই শক্তির পতন ঘটল।একই ভাবে উত্তর পশ্চিম ভারতে মহারাণা রণজিৎ সিংহের নেতৃত্বে যে শিখ শক্তির উত্থান হয়েছিল তাও এই মহারাণার মৃত্যুর পর (১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দ ) ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।
ভারতবাসীর অনৈক্য, হীন চক্রান্ত , সর্বদাই এক অংশের দেশবাসীর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে সহযোগিতার কথা নেতাজি তাঁর এই গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তিনি বাংলার নবাব সিরাজ – উ – দ্দৌলার বিরুদ্ধে তাঁর প্রধান সেনাপতি মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার কথা উল্লেখ করেছেন। দুজনেই ছিলেন ধর্মে মুসলমান, অপরদিকে নবাবের হয়ে যে সেনাপতি দৃঢ়তার সঙ্গে যুদ্ধ করলেন সেই মোহনলাল ছিলেন হিন্দু।নেতাজি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে টিপু সুলতানের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের কথা উল্লেখ করেছেন।এক্ষেত্রেও তিনি বিশ্বাসঘাতক মারাঠা পেশোয়া ও হায়দরাবাদের নিজামের ব্রিটিশদের সঙ্গে সহযোগিতার কথা উল্লেখ করেছেন।
ইংরেজ ঐতিহাসিকরা নবাব সিরাজের চরিত্রে কলঙ্ক লেপনের জন্য চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখেনি।তারা সিরাজ কর্তৃক অন্ধকূপ হত্যার কাহিনী প্রচার করেছিল।তারা বলেছিল নবাবের নির্দেশে নাকি একটি ছোট ঘরে শতাধিক ইংরেজ নারী পুরুষকে আটক রাখার ফলে তাদের শ্বাসরোধ হয়ে মৃত্যু হয়।এর স্মৃতিতে তারা ডালহৌসি স্কোয়ারে হলওয়েল মনুমেন্ট স্থাপন করে। নবাব সিরাজ উ দ্দৌলার চরিত্রে কলঙ্ক আরোপের এই সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের বিরুদ্ধে নেতাজির নেতৃত্বে ১৯৪০ সালে ‘হলওয়েল মনুমেন্ট’ অপসারণ আন্দোলন শুরু হয়।নেতাজি গ্রেপ্তার হন।কিন্তু অবশেষে ব্রিটিশ সরকার এই মনুমেন্ট অপসারণ করতে বাধ্য হয়। টিপু সুলতানের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অসমসাহসী সংগ্রামকে নেতাজি স্মরণীয় করে রেখেছিলেন তাঁর আজাদ হিন্দ সরকারের পতাকায়।টিপু সুলতানের ব্যাঘ্রকেতনের উল্লম্ফনরত বাঘ (Springing Tiger ) স্থান পেয়েছিল আজাদ হিন্দ সরকারের ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকায় চরখার সঙ্গে।
প্রাচীন ভারতে মৌর্য ,গুপ্ত বা হর্ষবর্ধনের শাসনে প্রজাতান্ত্রিক রাজ্যগুলির অধিকারে হস্তক্ষেপ করা হতনা।সম্রাটের রাজকোষে নিয়মিত রাজস্ব জমা পড়লে প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা কোনরকম হস্তক্ষেপ ছাড়াই স্বাধীনভাবে পরিচালিত হত।নেতাজি মধ্যযুগের কেন্দ্রীয় মুসলিম শাসকবর্গ সম্পর্কে লিখেছেন:–
” যদিও কারও আমলে অসংযত স্বেচ্ছাচার দেখা গিয়েছে ,তদাপি প্রাদেশিক কিংবা স্থানীয় বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকার কদাচিৎ হস্তক্ষেপ করেছেন।
‘ সুবা ‘ বা প্রদেশের শাসনকর্তা অবশ্যই সম্রাটের দ্বারা নিয়োজিত হতেন,কিন্তু সম্রাটের রাজকোষে নিয়মিত রাজস্ব জমা পড়লে প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থায় কোনও রকম হস্তক্ষেপ করা হত না।অন্ধ গোঁড়ামির বশে, কখনও কখনও এক একজন শাসক ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করতেন বটে, কিন্তু দিল্লির সিংহাসন যিনিই দখল করুন না কেন — ধর্মীয়,সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বিষয়ে জনগণ মোটের উপর পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতেন।ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের প্রায় সকলেরই এই দোষ যে, তাঁরা এই বিষয়টি উপেক্ষা করে থাকেন , যে জনগণ বহুল পরিমাণে প্রকৃত স্বাধীনতা ভোগ করতেন, ব্রিটিশ শাসনে যা থেকে তাঁরা ছিলেন বঞ্চিত। আর্যদের ভারতজয়ের পূর্বে এবং পরে স্বয়ংশাসিত গ্রাম্য প্রতিষ্ঠান ভারতীয় জীবনের একটি চিরন্তন বৈশিষ্ট্য ছিল।কিন্তু ব্রিটিশ শাসনে এই সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে গেছে এবং আমলাতন্ত্রের দীর্ঘ – বাহু প্রসারিত হয়েছে সুদূরতম পল্লী পর্যন্ত। এমন এক বর্গফুট জমিও অবশিষ্ট নেই যেখানে মানুষে অনুভব করতে পারে যে তাদের নিজস্ব বিষয়কর্ম পরিচালনার ব্যাপারে তারা স্বাধীন।”
নেতাজির আজাদ হিন্দ ফৌজ ও আজাদ হিন্দ সরকার ছিল ধর্ম নিরপেক্ষতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মূর্ত প্রতীক।নেতাজি ১৯৪৩ এর ৮ ফেব্রুয়ারি জার্মানির কিয়েল বন্দর থেকে রওনা দিয়ে ৬ মে বিপদশঙ্কুল সমুদ্রপথ ডুবোজাহাজে অতিক্রম করে উত্তর সুমাত্রার সাবাং দ্বীপে পৌঁছন। এই পথে তিনি তাঁর সঙ্গী করেছিলেন আবিদ হাসানকে।তারপর টোকিও হয়ে ১৯৪৩ এর ২ জুলাই দুপুরে একটি ছোট যুদ্ধ বিমানে করে তিনি আবিদ হাসানকে নিয়ে এসে নামলেন সিঙ্গাপুরে। হিন্দুস্তানি ভাষায় মুমতাজ হুসেনের লেখা ও রাম সিংহ ঠাকুরের সুর দেওয়া গান গেয়ে অভ্যর্থনা জানানো হল প্রিয় নেতাকে :-
” সুভাষজি সুভাষজি উয়ো জান –
এ হিন্দ আ গয়ে,
উয়ো নাজ জিসপে হিন্দ কো,
উয়ো শান – এ- হিন্দ আ গয়ে।”
সুভাষচন্দ্র হচ্ছেন এশিয়ার আলো – ‘এশিয়াকে আফতাব’ এবার এশিয়াতে এসে গিয়েছেন ,এই হচ্ছে গানের বক্তব্য। ৪ জুলাই সিঙ্গাপুরের ক্যাথে থিয়েটারে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনাদের ও ভারতীয়দের এক বিশাল জমায়েতে বিপ্লবী রাসবিহারী বসু বাহিনীর সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব সুভাষচন্দ্রের হাতে তুলে দেন।
( ২)
আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর নেতাজি পরবর্তী প্রায় তিন মাস দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার তাইল্যান্ড , মালয় ও বার্মায় সফর করেন। সিঙ্গাপুরের মতন এইসব দেশেও প্রচুর ভারতীয় বসবাস করতেন।যাঁদের মধ্যে প্রচুর তামিল ছিলেন।নেতাজির হিন্দুস্তানি ভাষায় দেওয়া বক্তৃতাগুলি দ্রুত তামিল ভাষায় অনুবাদ করে তাঁদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হত।ভারতীয়দের মধ্যে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ ছিলেন।নেতাজির প্রতি তাঁদের ছিল গভীর শ্রদ্ধা। তাঁর আহ্বানে ৯ জুলাই সিঙ্গাপুরে ৬০ হাজার মানুষের বিশাল জমায়েত হয়। এখানে নেতাজির উদাত্ত আহ্বানের পর ১৮ হাজার নাগরিক যাঁদের অধিকাংশই তামিল আজাদ হিন্দ ফৌজে যোগ দেন। এই সঙ্গে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির প্রায় ৪০ হাজার সেনাও আজাদ হিন্দ ফৌজে যোগ দেন।
নেতাজি বার্মার (বর্তমান মায়নামার ) রাজধানী রেঙ্গুন বা ইয়াঙ্গনে আসেন ১৯৪৩ এর সেপ্টেম্বরে। ভারতের শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে ব্রিটিশরা সিপাহী বিদ্রোহ দমন করার পর গ্রেপ্তার করে এই শহরে নির্বাসিত করেছিল।তাঁর সমাধি এইখানে।২৬ সেপ্টেম্বর নেতাজি সম্রাটের সমাধি পরিদর্শন করে শ্রদ্ধা জানান।সমাধির সামনে আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনারা কুচকাওয়াজ করে গার্ড অফ অনার জানায়। নেতাজি এখানে বলেন :–
“ধর্মবিশ্বাস যা-ই হোক না কেন, আমরা ভারতীয়রা সর্বদা বাহাদুর শাহের স্মৃতি বহন করে চলি।তিনি বহিরাগত শত্রুকে হটানোর জন্য দেশবাসীকে আঘাত হানার আহ্বান জানিয়েছিলেন।কিন্তু তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা শুধু সেই কারণেই নয়। ইনিই সেই মানুষ যাঁর পতাকার তলায় দাঁড়িয়ে সে দিন সব প্রদেশের ভারতীয় , সব ধর্মবিশ্বাসের ভারতীয় একযোগে লড়াই করেছিল, যাঁর পবিত্র পতাকার তলায় মুক্তি – প্রিয় হিন্দু , মুসলিম , শিখরা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছিল। ইংরেজ ঐতিহাসিকরা সেই যুদ্ধের নাম দেয় সিপাহী বিদ্রোহ , আমরা ভারতীয়রা অবশ্য বলি , এ-ই আমাদের স্বাধীনতার প্রথম যুদ্ধ।”
নেতাজির উপরোক্ত বক্তব্য থেকে একথা বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় না যে নেতাজি ভারতীয়দের ধর্ম নির্বিশেষে সুদৃঢ় ঐক্যের ওপর কিরকম গুরুত্ব আরোপ করতেন।রেঙ্গুন ও সংলগ্ন অঞ্চলে বসবাসকারী ভারতীয়রা উদ্দীপনার সঙ্গে আজাদ হিন্দ বাহিনীর জন্য সাধ্যমতন দান করেন।মহম্মদ হাবিব ধনী ব্যবসায়ী নেতাজির গলার মালা কিনলেন সর্বস্ব দিয়ে যার মূল্য ১ কোটি টাকা। কয়েকদিন পর ২ অকটোবর মহাত্মা গান্ধির ৭৫ তম জন্ম দিবসে নেতাজি ব্যাঙ্কক – এর আজাদ হিন্দ বেতার কেন্দ্র থেকে ভাষণে বলেন: — “ভারতবর্ষ ও ভারতের স্বাধীনতার জন্য মহাত্মা গান্ধির আচরিত সেবা এত বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ও অতুলনীয় যে আমাদের জাতীয় ইতিহাসে চিরদিনের মতন তাঁহার নাম স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকিবে।” ওই ভাষণেই নেতাজি বলেন:-
“একথা বলিলে অত্যুক্তি হইবে না যে ১৯২০ সালে যদি তিনি তাঁহার অস্ত্র লইয়া না আসিতেন, তাহা হইলে সম্ভবত আজও ভারত হতাশায় মুহ্যমান থাকিত। ভারতের স্বাধীনতার জন্য তাঁহার সেবা অমূল্য ও অতুলনীয়।অনুরূপ অবস্থায় একটিমাত্র জীবনকালে একটিমাত্র ব্যক্তি ইহা অপেক্ষা অধিকতর কৃতিত্ব অর্জন করিতে পারেন না। বোধ হয় মহাত্মা গান্ধির সহিত নিকটতম ঐতিহাসিক সাদৃশ্য আছে মুস্তাফা কামাল পাশার , যিনি বিগত বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের পরাজয়ের পর তাহাকে রক্ষা করেন এবং তাঁহাকে তুর্কীরা ‘তুরস্কের গান্ধি’ আখ্যা দিয়াছিলেন।”
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধির রাজনৈতিক কৌশল যে অহিংসায় সীমিত নয়, তার মতবাদে যে আরও অনেক সদর্থক ভাবনা ছিল সুভাষ তা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। সুভাষের সেই অনুভবের প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায় তাঁর বিভিন্ন লেখায়, বক্তৃতামালায়। এমনকি ১৯৪৩-এ তাঁর আজাদ হিন্দ সরকার যখন আত্মপ্রকাশ করল, তখন দেখা গেল সেটি মোটের ওপর গান্ধিজির বিশ্বদর্শনের ওপরেই স্থাপন করা হয়েছে।
নেতাজী স্বাধীন ভারতকে কখনও একটি হিন্দুপ্রধান দেশ হিসাবে কল্পনা করতেন না। তাঁর সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের ভাষা ছিল হিন্দুস্তানি, যা হিন্দি ও উর্দুর এক মিশ্রিত রূপ। তার অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল পাশ্চাত্য এবং বৈদিক সমাজতন্ত্রের সংমিশ্রণে। যে কোনও সমাজে উন্নতির পথে নারীজাতির ভূমিকা প্রশ্নাতীত।নেতাজি তাঁর ‘ ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল ‘ গ্রন্থে লিখেছেন ভারতে ব্যাপক নারী জাগরণ ও স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁদের ব্যাপক অংশ গ্ৰহণের পথিকৃৎ মহাত্মা গান্ধি। সুভাষের কাছে যুগ যুগান্তরের মানবিক অবক্ষয়ের সব থেকে বড় উদাহরণ ছিল ভারতে হিন্দু-মুসলমান সমাজে নারীদের সামাজিক অধোগতি। তিনি তাই তাঁর সরকারে ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী স্বামীনাথনকে পূর্ণ মর্যাদায় সমগ্র নারীসমাজের পূর্ণাঙ্গ উন্নয়নের দায়িত্বভার দেন। অনুরূপভাবে গান্ধিজিও বারংবার তাঁর নানা লেখায় নারী উন্নয়নের ওপর জোর দিয়েছিলেন।
১৯৪৩ এর ২১ অকটোবর সিঙ্গাপুরের ক্যাথে থিয়েটারে আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনানি ও বিপুল সংখ্যক ভারতীয়দের উপস্থিতিতে ‘ আজাদ হিন্দ সরকার ‘ , হিন্দুস্তানি ভাষায় ‘আর্জি হুকুমত এ আজাদ হিন্দ’ গঠিত হয়। নেতাজির নিজের করা খসড়া ঘোষণাপত্র নিজে পাঠ করেন।ঘোষণাপত্রে বলা হয়:- ‘…..এই সাময়িক সরকার নিজের অধিকারবলে সকল ভারতীয়ের আনুগত্য দাবি করছে।সকল নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতা , সমান অধিকার , সমান সুযোগের অধিকার নিশ্চিত করা এই সরকারের কর্তব্য।অতীতে বিদেশি শাসকের দুষ্ট অভিসন্ধির ফলে যত রকম বৈষম্য আজ প্রকট হয়ে উঠেছে , সেই সমস্ত বৈষম্য দূর করে সমগ্র জাতিকে সুখ ও সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাওয়ার দৃঢ় অভীপ্সা ঘোষণা করছে এই সরকার।’
আজাদ হিন্দ সরকারের আদর্শ হল তিনটি উর্দু শব্দ – ইতমদ ( বিশ্বাস) , ইত্তেফাক (ঐক্য) এবং কুরবানি (ত্যাগ)। সরকারের পতাকার রঙ তেরঙ্গা , মধ্যে থাকল গান্ধিজির চরকা। উল্লম্ফনরত ব্যাঘ্র থাকত ইউনিফর্মের কাঁধে ত্রিবর্ণ অংশের ওপরে, ব্রিটিশের বিরুদ্ধে টিপু সুলতানের সাহসী প্রতিরোধের কথা স্মরণ করে। হিন্দি আর উর্দুর মিশ্রণে গড়ে ওঠা হিন্দুস্তানি ভাষা, আর রোমান লিপি – জাতীয় ভাষা ও জাতীয় লিপি হিসাবে নির্ধারিত হল।দক্ষিণ পুব এশিয়ায় বিপুল তামিল জনসংখ্যার কথা চিন্তা করে সরকারের নির্দেশগুলি তামিল ভাষায় অনুবাদ করে দেবার সিদ্ধান্ত হয়। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের কথা মনে করিয়ে দিতে নেতাজি বাহিনীর তিনটি ব্রিগেডের নামকরণ করলেন মহাত্মা গান্ধি পন্ডিত নেহরু ও মৌলানা আজাদের নামে। নারীবাহিনীর নাম হল ‘ঝাঁসির রানী ব্রিগেড’।
সহজ হিন্দুস্তানি ভাষায় অনুবাদ করে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে’ হল জাতীয় সঙ্গীত।নেতাজির নির্দেশে আবিদ হাসান ও মুমতাজ হুসেন গানটির মূল ভাব অনুবাদ করেন।গানের দ্বিতীয় স্তবকে কবিগুরু লিখেছিলেন :-
‘অহরহ তব আহ্বান প্রচারিত, শুনি তব উদার বাণী
হিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈন পারসিক মুসলমান খৃস্টানী
পূরব পশ্চিম আসে তব সিংহাসন-পাশে
প্রেমহার হয় গাঁথা।’
আজাদ হিন্দের সেনানীরা গাইলেন :
‘সব কে দিল মে প্রীত বসায়ে তেরি মিঠি বাণী
হর সুবে কে রহনেওয়ালে হর মজহব কে প্রাণী
সব ভেদ ঔর ফারাক মিটাকে
সব গোদ মে তেরি আকে
গুঞ্জে প্রেম কি মালা।’
আজাদ হিন্দ বাহিনীর প্রতিটি সেনাই দেখা হলে পরস্পরকে ‘জয় হিন্দ’ বলে সম্বোধন করতেন।নেতাজি ও তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজ ভারতবর্ষের বহুত্ববাদ ও ধর্ম নিরপেক্ষতার মহান আদর্শের প্রতি অন্তর থেকে শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।এই বাহিনীতে ব্রিটিশ আর্মির মতন ধর্মভিত্তিক পৃথক পৃথক ‘চৌকা’ অর্থাৎ ‘রান্নাঘর’ ছিলোনা । সবার জন্য একই চৌকা। কোনও ধর্ম ও জাতের বিভাজন ছিলোনা। যুদ্ধের পর বন্দী আজাদ হিন্দ সেনাদের দেশে নিয়ে আসা হয়। গান্ধিজি যখন তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে যান, তাঁরা অভিযোগ করে ব্রিটিশ সরকার আবার ধর্ম অনুযায়ী পৃথক পৃথক চৌকা চালু করেছে, যা নেতাজির নীতির বিরোধী। গান্ধিজি তাঁদের বলেন ‘তিনি ব্রিটিশ সরকারকে বলবেন আজাদ হিন্দের বন্দি সৈন্যদের জন্য তাদের প্রথা অনুযায়ী সব বন্দিশালায় একই চৌকা চালু করতে।’ এই শুনে বন্দি সেনারা বলেন তারা নিজেদের মতন ব্যবস্থা করে নিয়েছেন, তারা পৃথক পৃথক চৌকা থেকে খাবার এনে একসঙ্গে মিশিয়ে নিয়ে খান। এই কথা শুনে গান্ধিজি অভিভূত হন। তিনি বলেন ‘সুভাষ অসাধ্য সাধন করেছে।’
মন্ত্রিসভার সদস্য ও বাহিনীর অন্যতম সেনাধ্যক্ষ শাহ নওয়াজ খান তাঁর ‘আজাদ হিন্দ ফৌজের ইতিহাস’ গ্রন্থে নেতাজির ধর্ম নিরপেক্ষ মন, নীতি ও কাজের অসংখ্য উদাহরণ দিয়েছেন। তিনি তাঁর দুঃসাহসিক অন্তর্ধানের পর পেশোয়ারে গিয়ে যাঁর কাছে আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি মোহাম্মদ আকবর শাহ ।জার্মানি থেকে জাপান তাঁর দুঃসাহসিক সাবমেরিন যাত্রার একমাত্র ভারতীয় সঙ্গী আবিদ হাসান। কোহিমা ও ইমফল অভিযানের দায়িত্ব দিয়েছিলেন শাহ নওয়াজ খান ও মোহাম্মদ জামান কিয়ানীকে। মণিপুরের মৈরাঙ পতনের পর যিনি জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন তিনি সৈকত মালিক।নেতাজি সিঙ্গাপুর ত্যাগের আগে যে সেনাধ্যক্ষকে ডেকে ওই শহরে আজাদ হিন্দ ফৌজের শহিদ সেনাদের স্মৃতিতে সহিদসমার্ক নির্মাণের দায়িত্ব দেন , তিনি একজন খ্রিস্টান – জন সিরিল স্ট্রেচি। নেতাজি সিঙ্গাপুর থেকে অনির্দেশের উদ্দেশে তাঁর শেষ বিপজ্জনক যাত্রায় যাঁকে সঙ্গী করেন তিনি কর্নেল হাবিবুর রহমান।আর লালকেল্লার সামরিক আদালতে যে তিনজন আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনানায়কের বিখ্যাত বিচার হয়েছিল তাঁরা হলেন শাহ নওয়াজ খান, প্রেমকুমার সায়গল ও গুরুবক্স সিং ধীলন।একজন মুসলমান, একজন হিন্দু ও একজন শিখ। আজাদ হিন্দ ফৌজের অন্যান্য সেনাধ্যক্ষদের স্মৃতিচারণেও একই কথা উঠে এসেছে।ভারতবর্ষের মতো এত বিশাল এক মহাদেশে যে কেবল একটা রাজনৈতিক পথ থাকবে, সংখ্যাগুরুর ধর্মের সর্বগ্রাসী আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে এই কথা গান্ধিজি বা নেতাজি সুভাষের কোনও লেখায় পাওয়া যাবে না।
তবে এই বিরোধের কথা আছে কাদের বইয়ে? সংঘ পরিবারের। আজ নেতাজী তাদের কাছে রণবেশধারী সেনাপতি, হিন্দু, মানে এক বিশেষ রকমের হিন্দু, যিনি পৌরুষে ভরপুর, মুসলিম বিতাড়নের মহাসৈনিক হিসেবে আবির্ভূত হতে চলেছেন— রাজধানী দিল্লির বিখ্যাত রাজপথে, ইন্ডিয়া গেটের ঠিক পাশে।