Share it

যীশু চৌধুরী: ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে ঘোর সংকটের শুরু হয়েছিল তা আপাতত স্থগিত বলে মনে হচ্ছে। দুপক্ষের ইচ্ছেতেই এটা সম্ভব হয়েছে। তবে একথা বলতে হবে, ভারতই মূলত এই স্থগিতের ব্যাপারে সায় দিয়েছে। তবে তাতে এভাবে রাজি হওয়ার কারণ কী সেটা আমজনতার কাছে পরিষ্কার নয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এব্যাপারে যে ভাষণ দিয়েছেন ধরে নেওয়া যেতে পারে সেটিই আসল ব্যাপার। তার বাইরে বা ভিতরে কিছু থাকলে সেটা নেহাতই কূটনীতি এবং কূটনীতি সবসময় সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। তার দরকারও আছে। কূটনীতি ব্যাপারটা উচ্চস্তরের নেতাদের মধ্যেই থাকা ভালো।

শোনা যাচ্ছে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নাকি এই সংঘর্ষ বিরতির জন্যে অনেকটাই কৃতিত্বের অধিকারী। অন্তত সেরকম দাবি তিনি নিজেই করেছেন। কিন্তু এই দাবি করার আগে আমেরিকার ইতিহাসটা আরেকটু ভালোভাবে পড়ে নিলে পারতেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। যিনি ভারত-পাকিস্তানের ইতিহাস যে জানেন না, সেটা প্রমাণ হয়েছে তাঁর একটি উক্তিতে। কয়েকদিন আগে তিনি বলেছিলেন ভারত-পাকিস্তান নাকি সীমান্তে প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে যুদ্ধ করছে। দেড় হাজার বছরের অঙ্কটাও সম্ভবত ডোনাল্ড ট্রাম্পের জানা নেই।

এভাবে দুটি দেশের মধ্যে সংঘর্ষ থামিয়ে দেওয়ার যে প্রক্রিয়া তা তৃতীয় একটি দেশের দিক থেকে কতখানি সংগত সেটা ভেবে দেখার দরকার আছে। এই সংঘর্ষ এবং সংঘর্ষ বিরতি থেকে এমন কথাও প্রমাণ হচ্ছে যে আমেরিকা এবং চিন ওপরে যতই কুস্তির প্যাঁচ দেখাক আসলে ভেতরে ভেতরে তারা পরম সখা। বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তান নিয়ে সম্প্রতি যা ঘটছে তাতে এটা পরিষ্কার। বাংলাদেশে গত বছর জুলাই মাসে যে পট পরিবর্তন হয়েছে তার গণতান্ত্রিক স্বীকৃতি এখনও পাওয়া যায়নি। এই পট পরিবর্তনের পিছনে আমেরিকার হাত আছে এটা বাংলাদেশেরই কোনও কোনও মহলে সন্দেহ। বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের কয়েকটি দ্বীপ এবং কক্সবাজার নিয়ে আমেরিকা একটি অধিকার কায়েম করতে চাইছে বেশ কিছুদিন ধরে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই কায়েমের মোটেই সায় দিয়ে চাননি। তিনি তখনই নাকি ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছিলেন বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশকে কোনওভাবেই আমি বিদেশের হাতে তুলে দেব না। তাঁর এই অনমনীয় মনোভাবের জন্যই সম্ভবত তাঁকে পদচ্যুত হতে হল। এবং তারপরে যে শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাকে নিশ্চিতভাবে কোনও সুশাসন বলা যায় না। যেভাবে মৌলবাদীরা বাংলাদেশ জুড়ে ব্যাপক উল্লাস শুরু করেছেন তাতে প্রকৃত দেশপ্রেমী বাংলাদেশীরা শুধু ক্ষুব্ধ নন, ক্রুদ্ধও বটে। মনে হয় এরপর বাংলাদেশে আরও কিছু ঘটতে পারে। যে মৌলবাদী শাসন এখন চলছে তার কর্তাব্যক্তিরা কথায় কথায় আমেরিকা এবং চিনকে টেনে আনছেন ফলে বকলমে চলে আসছে পাকিস্তানও। এমনও শোনা গেছে, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (ISI) বাংলাদেশে বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র মজুত করে ফেলেছে। অন্যদিকে সরকারের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক ডক্টর মহম্মদ ইউনুস ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে জানিয়েছিলেন, এই অংশের মানচিত্র নাকি পরিবর্তন হতে চলেছে। অন্য এক কর্তা দাবি করেছিলেন, বাংলাদেশ নাকি খুব শিঘ্রই উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্য দখল করে নেবে। অন্য এক মৌলবাদী সম্প্রতি এক ভিডিও প্রকাশ করে বলেছেন, কলকাতা দখল করতে নাকি তার বেশি সময় লাগবে না। তার মানে বাংলাদেশের মাথায় রয়েছে এক বৃহৎ বঙ্গ। এই পরিকল্পনার পেছনে আমেরিকা এবং চিনের কোনও কোনও মহলের হাত থাকতেও পারে।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে ঘটে গেছে পহেলগাঁও ঘটনা। মনে হয় হিসেব করেই হত্যাকাণ্ডটি ঘটানো হয়েছে। ২৬ জন নিরীহ পর্যটককে গত ২২ এপ্রিল সশস্ত্র জঙ্গিরা যেভাবে মেরে ফেলেছে তার সঙ্গে কোনও ধর্ম বা রাজনীতির সম্পর্ক প্রায় নেই বললেই চলে। এর পেছনে নেহাতই কোনও কোনও বড় মহলের চক্রান্ত আছে, এমনটাই হতে পারে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই স্পর্শকাতরতা দেখলে সেটা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। তিনি কোনও বাদবিচার না করে ভারত ও পাকিস্তানকে একই স্তরে বসিয়ে মীমাংসার কথা বলেছেন। আর নিজের দেশ যখন সন্ত্রাসবাদীদের দ্বারা বিপন্ন হয় তখন বিদেশের মাটিতে এসেও সেই সন্ত্রাসবাদীকে নিকেশ করে দিতে দ্বিধা করে না। এমনকী মুম্বইয়ে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পরেও আমেরিকা কিন্তু পাকিস্তানকে কোনও তিরস্কার করেনি বা তার বিরুদ্ধে কোনও নিন্দাও করেনি। কেবল সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েই ক্ষান্ত থেকেছে। একইভাবে নীরবতা ছিল চিনেরও। চিন অবশ্য ইদানিং সন্ত্রাসবাদের পক্ষেই নানা কর্মসূচি নিচ্ছে। যেমন আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, তুরস্ক, পাকিস্তান প্রভৃতি এলাকার ঘটনা। এই ঘটনাগুলির মধ্যে দিয়ে প্রমাণ হচ্ছে অন্যরা সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন না করলেও চিন একাই তাদের মধ্যে মৌরুসীপাট্টা গেড়ে বসে পড়তে চাইছে। তালিবানি শাসনের পরেও আফগানিস্তান সম্পর্কে চিন একই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলেছে। অর্থাৎ চিন চায়, অন্যেরা দূরে থাকুক সে একাই যেন রাজ করতে পারে। সেই রাজের প্রকৃতি যেমনই হোক না কেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চিন সম্পর্কে ইদানিং অনেকেই সচেতন। ভারতের বহু সচেতন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিও যথেষ্ট প্রখর। আমেরিকা এবং চিনের সাম্প্রতিক কাজকর্ম যে তাদের পছন্দ নয় তার প্রমাণ মায়ানমার থেকে শুরু করে বেলুচিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত। তার মধ্যেই আছে বাংলাদেশ এবং কাশ্মীর।

এই দুটি বড় দেশই ভারতে ভয় পেতে শুরু করেছে এবং তাকে আর বাড়তে দেওয়া যাবে না। হয়তো এমন মনোভাব নিয়েই চলেছে। কয়েক বছর আগে সারা পৃথিবীতে শেয়ার বাজারে যে ব্যাপক ধস নেমেছিল তার ফলে কোটি কোটি মুদ্রার অঙ্ক হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে অনেকেরই ধারণা ছিল এর পেছনে চিন এবং আমেরিকাই তৎপর ছিল। ওই দুই দেশের শেয়ার বাজারে কিন্তু কোনও ক্ষতি হয়নি। আবার ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যাচ্ছে বাণিজ্য শুল্ক নিয়ে আমেরিকা এবং চিন নিজেদের মধ্যে সমঝোতায় পৌঁছবার চেষ্টা করছে। যে ডোনাল্ড ট্রাম্প বাণিজ্য নীতি নিয়ে এত লাফাই ঝাঁপাই করলেন তিনি হঠাৎ চিনের ব্যাপারে এত নরম কেন তা বুঝতে কী বেশি সময় লাগবে।

দু-দেশের মধ্যে বাণিজ্য বন্ধ হতে পারে এই হুমকি দেওয়া ছাড়াও মার্কিন প্রেসিডেন্ট নাকি ভারতকে পাকিস্তানি পরমাণু অস্ত্রের বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। তা যদি সত্যি হয় তাহলে তাতো আরও মারাত্মক। তাহলে কী বুঝতে হবে ডোনাল্ড ট্রাম্প পরমাণু অস্ত্রের গুরুত্ব বোঝেন না নাকি নিজের দেশ বাদ দিয়ে যে কোনও দেশে পরমাণু অস্ত্রের প্রয়োগে তাঁর কোনও তাপউত্তাপ নেই ?

আশ্চর্যজনকভাবে এই সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপ এবং এশিয়ার বহু দেশেই ভারতের অবস্থানকে সমর্থন করেছে। জাপানও এর মধ্যে আছে। সম্প্রতি জাপানে একটি চিনা গোয়েন্দা বিমানকে ঢুকে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে বলে টোকিও-র সরকারি সূত্র জানিয়েছে। তাইল্যান্ডও সম্প্রতি অভিযোগ করেছে তাদের উপকূলের খুব কাছেই চিনা জাহাজ বিপজ্জনকভাবে ঘোরাফেরা করছে। এছাড়া অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স এমনকী রাশিয়াও ভারতের এই অবস্থানকে সমর্থন জানিয়েছে এবং পরিষ্কার বলেছে পাকিস্তানের মদত পাওয়া সন্ত্রাসবাদীরা যেভাবে দিনের পর দিন ভারতে ঢুকে হামলা চালাচ্ছে এবং নিরীহ নাগরিকদের খুন করছেন তাতে ভারতের পক্ষে এমন প্রতিক্রিয়া জানানোই স্বাভাবিক এবং ভারত সেটাই করেছে। মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ভারতের সামরিক শক্তি পাকিস্তানের বহু সামরিক এলাকাকে উড়িয়ে দিয়েছে এবং সন্ত্রাসবাদীদের ঘাঁটিও নির্মূল করেছে। বহু সন্ত্রাসবাদী নিহতও হয়েছে। তাই আমেরিকা বা চিন পাকিস্তানকে যতই ইন্ধন দিক এবং দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে তারা যেভাবে ঘাঁটি গাড়ার চেষ্টা করুক তাতে সুবিধে হবে না। কারণ এখানকার বিপুল গণতান্ত্রিক মানুষজন এব্যাপারে পুরোপুরি সচেতন। এবং যেখানে দরকার হবে সেখানে তারা প্রতিরোধ করবে। তা সে মায়ানমার হোক, কক্সবাজার হোক, বালুচিস্তান হোক বা পোশোয়ারই হোক। আমেরিকা এবং চিনের কোনও গোপন এজেন্টরা কোনওভাবেই যে সফল হবে না সেটা সম্প্রতি ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষ এবং সংঘর্ষ বিরতির মধ্যে দিয়ে পরিষ্কার হয়ে গেছে।

Share it