Share it

সুদীপ্ত চক্রবর্তী: শেষ পর্যন্ত আমাদের এই ভারতীয় উপমহাদেশকে একটি অখণ্ড রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চাইছেন ভারতের বাইরেকার বেশ কয়েকজন প্রতিবেশী বুদ্ধিজীবী ও নেতারা। এব্যাপারে বাংলাদেশ থেকে যেমন দাবি উঠেছে তেমনই দাবি উঠেছে বেলুচিস্তান থেকে। গত শনিবার এক বিশিষ্ট বালোচ নেতা ভারতীয় একটি টিভি সাক্ষাৎকারে বলেছেন বালুচিস্তান তো আসলে ছিল তখনকার উত্তর-পশ্চিম ভারত। সেই স্মৃতি পূর্ব পুরুষদের কাছ থেকে আমরাও পেয়েছি। অন্যদিকে বাংলাদেশের মৌলবাদ বিরোধী শক্তিগুলি ঠারেঠরে বলতে শুরু করেছে, এই উপমহাদেশে অখণ্ড রাষ্ট্র গড়তে পারলে মৌলবাদের আশঙ্কা পুরোপুরি নির্মূল হয়ে যাবে। কারণ তখন আর পাকিস্তানের দুর্বল অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে মৌলবাদ ও সন্ত্রাসবাদকে তোল্লাই দেওয়ার কোনও প্রয়োজনই হবে না। পাকিস্তান তার জন্মের পর থেকেই একটি ভয়ের মনস্তত্ত্ব নিয়ে চলছে, চলছে এবং পরোক্ষে নিজেদের শক্তি বাড়ানোর কথা ভেবে সন্ত্রাসবাদীদের হাতে অবাধে ব্যাটন তুলে দিয়েছে। সেই সন্ত্রাসবাদীরা শুধু এখানেই নয় বিদেশেও নানা সন্ত্রাসবাদী কাজকর্ম চালাচ্ছে। প্যারিস, আমেরিকা, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশে তারা যেভাবে হঠাৎ হঠাৎ সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ চালিয়েছে তাতে এই প্রক্রিয়ার সমূল ধ্বংস চায় অনেকেই। বালুচিস্তান ছাড়াও পশ্চিমদিকে আর একটি এলাকা পাখতুনিস্তান বা পাখতুনখোয়া নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে। দেশভাগের সময়ই এই অঞ্চলের বিশিষ্ট নেতা সীমান্ত গান্ধী আবদুল গফ্ফর খান তৎকালীন ভারতীয় নেতাদের কাছে দাবি জানিয়েছিলেন পাখতুনিস্তানকে যেন পাকিস্তানের অন্তর্গত না করা হয়। কিন্তু তারপরেও যখন জিন্নার দাবির কাছে পাখতুনিস্তানকে ছেড়ে দেওয়া হয় তখন সীমান্ত গান্ধী আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “আমাকে নেকড়ের মুখে ফেলে দেওয়া হল”।

ইদানিং বাংলাদেশের যে মনোভাব দেখা যাচ্ছে আসলে তা দেখা গিয়েছিল পাকিস্তান থেকে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আবির্ভাবের সময়ই। তখনও মৌখিকভাবে অনেকেই বলতেন বাংলাদেশের উচিত ভারতেরই সঙ্গে জুড়ে যাওয়া। অবশ্য সেই ধরনের ব্যক্তিরা পরে ঢাকায় ফিরে গিয়েছিলেন এবং সেখানে বসবাস করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু এই মনোভাব যে ছিল তার কারণ, মৌলবাদের আশঙ্কা। এবং সেটাই সত্যি হয়েছিল। গত জুলাই মাসে বাংলাদেশে ব্যাপক পরিবর্তনের পর কেউ কেউ বলেছেন বাংলাদেশকে তখনই ভারতের সঙ্গে যুক্ত করতে পারলে ভালো হত।

তাঁদের যুক্তি ভারতে এখন মোটামোটিভাবে ২২ কোটি মুসলমান বাস করেন। বাংলাদেশে মুসলমানের সংখ্যা তার চেয়ে কম। পাকিস্তানে আরও কম। অথচ ভারতে সেভাবে কোনও মৌলবাদ বা সন্ত্রাসবাদের জায়গা নেই। ভারতের মুসলিমরা কখনও কোনও বিক্ষোভ দেখান বা প্রতিবাদ মিছিল, সমাবেশের আয়োজন করেন বটে কিন্তু তা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বজায় রেখেই। ভারতের মুসলমানরা সেভাবেই আন্দোলন করেন যেভাবে অন্যরাও আন্দোলন বা মিছিল সমাবেশ করে থাকেন। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মুসলিমরা যদি এই অবস্থানে এসে মিশতেন তাহলে বুঝতেন পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মতো নয়, ভারত সত্যিকারের একটি গণতান্ত্রিক দেশ। এদেশের সেনাবাহিনী কখনওই রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামায় না এবং রাজনীতির কোনও ব্যাপারে অংশও নেয় না। সেকারণে রাজনৈতিক দলগুলি এবং বিভিন্ন দলের নেতারা সেনাবাহিনীকে সত্যিকারের প্রতিরক্ষার প্রাচীর বলে মনে করেন। ফলে এখানে ধর্মের কোনও আলাদা সুযোগ নেই। সবাই যে সুযোগ পেয়ে থাকেন ধর্মীয় নেতারা, তা যে কোনো ধর্মেরই হোক না কেন, সেই একই সুযোগ পেয়ে থাকেন। ফলে প্রতিবেশী দেশগুলির মুসলিমরা ভারতে প্রকৃত গণতন্ত্রের স্বাদ পেতে পারতেন।

তবে পরিস্থিতি এত সহজ নয়, সেটাও সকলেরই জানা। কারণ এত বড় এলাকা যা শুরু হয়েছে চট্টগ্রাম থেকে এবং শেষ হয়েছে আফগানিস্তান ও ইরানের সীমান্তে গিয়ে। পূর্ব থেকে পশ্চিমের এই অবস্থা। উত্তর থেকে দক্ষিণে অবশ্য কোনও সমস্যা নেই। কারণ এই এলাকা পুরোপুরি অখণ্ড।
বাংলাদেশের অন্যতম সেনাপ্রধান এবং পরবর্তীকালের প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান উপমাহাদেশকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্যে সার্ক আন্দোলন শুরু করেছিলেন। এই আন্দোলনের অন্তর্ভুক্ত আছে ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ-নেপাল-ভুটান-শ্রীলঙ্কা এবং মলদ্বীপ। এর মধ্যে নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা এবং মলদ্বীপ দৃশ্যত এবং ঐতিহাসিকভাবে অন্য দেশ উপমহাদেশের সঙ্গে তারা ভৌগলিকভাবে সংশ্লিষ্ট বলেই এই আন্দোলনে যোগ দিতে সম্মত হয়েছিলেন। অবশ্য ইদানিং সার্ক-এর কাজকর্মে ভাটা পড়েছে। তার কারণ সম্ভবত সংশ্লিষ্ট দেশগুলির রাজনৈতিক টানাপোড়েন। শোনা যাচ্ছে ইতিমধ্যে বালুচিস্তান নাকি স্বাধীনতা ঘোষণা করে দিয়েছে এবং সেদেশে নাকি পাকিস্তানের কোনও পতাকা আর উড়ছে না। এখবর যদি সত্যি হয় তাহলে বুঝতে হবে উপমহাদেশের মানচিত্র অতি দ্রুত বদলাতে শুরু করে দিয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশেও বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আওয়ামি লিগ-কে নিষিদ্ধ করে দেওয়ার ফলে সেদেশের রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া কতটা কার্যকর হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। কারণ অনেকেই আওয়ামি লিগ-কে নিষিদ্ধ করার জন্য ক্ষুব্ধ এবং আশঙ্কিত। তাঁদের মতে, কোনও দলকে নিষিদ্ধ করে নির্বাচনে যাওয়া গণতন্ত্রকে অস্বীকার করা।

এই অবস্থায় উপমহাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকেই ভাবিত। সেই ভাবনার মধ্যে রয়েছেন বাঙালি, উর্দুভাষী, পঞ্জাবি, বালোচ, পাখতুন, সিন্ধি প্রভৃতি মানুষজন। তাই এর সম্ভাবনা এখন যথেষ্টই বিস্তৃত এবং ব্যাপক। অদূর ভবিষ্যতে ক্রমেই জানা যাবে সত্যিই কী ঘটতে চলেছে।

Share it