প্রফুল্লকুমার পাল: জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল এক ভয়াবহ জল সংকটের (Water Crisis) সম্মুখীন হতে চলেছে। ভারতের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় জানা গিয়েছে যে বেঙ্গালুরুতে বিশাল বিশাল হাউজিং ভুগর্ভস্থ জল ব্যবস্থাকে কার্যত বিপর্যস্ত করে তুলছে। কোথাও কোথাও একারণে ধস নামার পরিস্থিতিও তৈরি হয়েছে। সুতরাং, দৈনন্দিন জল ব্যবহারের জন্যে জলের উপর ওই শহরে কঠোর নিয়ন্ত্রণ চালু হয়েছে।
চেন্নাইয়ে দীর্ঘদিন জলের সমস্যা চলছে। প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূর থেকে ট্রেনে করে জল এনে শহরের চাহিদা মেটাতে হচ্ছে। দিল্লিতেও জল সংকট ভয়াবহ। মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ এবং পাঞ্জাবে চাষবাসের কাজে বিপুল পরিমাণ ভূগর্ভস্থ জল ব্যবহার করে সেখানে এক গভীর পানীয় জলের সংকট তৈরি হয়েছে।
সমস্যা কেন
সমুদ্রের জল লবণাক্ত। সুতরাং, এটা দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্যে উপযুক্ত নয়। বৃষ্টির জল এবং বরফ গোলা জলে দৈনন্দিন কাজ করা হচ্ছে। এবং বেশিরভাগই মাটির ভেতর থেকে চুঁইয়ে বিভিন্ন জায়গায় জলস্তর তৈরি করে। এই জলস্তর মাটির গভীরে ৬০ ফুট থেকে ৫০০ ফুট পর্যন্ত বিস্তৃত। নগরায়ণের জন্যে বিভিন্ন শহর এবং নিকটবর্তী এলাকায় বিশাল হাইজিংগুলি তৈরি হয়েই চলেছে। এখানকার সকলেই পাম্পের সাহায্যে ভূগর্ভের জল তুলে ব্যবহার করছে। এছাড়া দেশি পণ্যের জন্যে বিভিন্ন জায়গায় ভূগর্ভস্থ জল ব্যবহার করা হচ্ছে। এরফলে আগামীদিনে সারা দেশে এক ভয়ানক জল সংকটের পরিস্থিতি তৈরি হবেই। প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ লিটার জল মাটির ভান্ডার থেকে তুলে এনে ব্যবহার করার ফলে পানীয় জলের উৎসগুলি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কারণ, এই জলই পরিস্রুত করে পান করার ব্যবস্থা থাকে। তাতেই যদি ব্যাঘাত ঘটে তবে পানীয় জলের সংকট নিশ্চিত। বর্ষাকালে যে বিশাল পরিমাণ বৃষ্টির জল রাস্তাঘাট ডুবিয়ে বন্যার সৃষ্টি করে সেই জলকে ঠিকমতো ব্যবহার করার জন্যেও উপযুক্ত ব্যবস্থা নেই। সেদিকেও নজর দেওয়া উচিত। বর্ষার সময়কার জল ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারলে সারা বছরের চাহিদাও মিটতে পারে।
বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য পাহাড়ের বরফ গলে সমুদ্রের জলস্তর যেখানে বেড়ে যাচ্ছে সেখানে নদী, নালা, খাল, ড্রেন পরিস্কার করার সঙ্গে বিশেষ প্রয়োজন ওই বৃষ্টির জলকে সংরক্ষণ করে রাখা। এবং সেই জলকে অতি দ্রুত ভূগর্ভে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা। ভারতের বিভিন্ন জায়গায় এই কাজে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আমাদের রাজ্যেও বহু জায়গায় বন্যার কবলে পড়ে মানুষ যেভাবে দুর্দশাগ্রস্ত হচ্ছেন সেটা চিন্তা করে সরকারি বা বেসরকারি এই কাজে উদ্যোগ নেওয়ার বিশেষ দরকার রয়েছে।
এই উদ্যোগ খুব একটা খরচ সাপেক্ষ নয়। জল সংগ্রহের ব্যবস্থা ছাড়া মাত্র ১০০ বর্গফুট জায়গার দরকার। মাঠের একপাশে পার্কে বা হাউজিং কমপ্লেক্সে এমন ব্যবস্থাও অনায়াসেই করা যেতে পারে। নির্দিষ্ট জায়গায় জল ১০ ফুট গর্ত করে জমিয়ে রাখা যায়। তবে তার আগে পাথরকুচি, চারকোল এবং বালি দিয়ে ভরাট করে জলস্তর পাঁচ ইঞ্চি মোটা প্লাস্টিক পাইপের মাধ্যমে ভূগর্ভে পাঠিয়ে দিয়ে ঠিক রাখা যায়। এই কাজটি করার জন্যে দরকার কোনও কেমিক্যাল যাতে না মেশে সে বিষয়ে সতর্কতা। জলস্তর বিশেষে পাইপের দৈর্ঘ ১৫০ ফুট থেকে ৪০০ ফুট পর্যন্ত হতে পারে। দু-দিকে উন্নতমানের প্লাস্টিক বা নাইলনের কাপড় জড়িয়ে পাঁচ ইঞ্জি ব্যসের পাইপে প্রতি ঘণ্টায় ৮৫ হাজার লিটার পর্যন্ত জল ভূগর্ভে পাঠানো যেতে পারে। জমির দাম বাদ দিলে খরচ মোটামোটি ৫০ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকা। বন্যাপ্রবণ বা নিচু এলাকায় যদি এই ব্যবস্থা করা যায় তাহলে আগামীদিনে বর্ষাকালে ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যেতে পারে। অর্থাৎ বন্যা রোধের এটা একটা বড় উপায়।
এই উদ্যোগে দুটি বিষয় সতর্ক থাকতে হবে। ১) বন্যার কবল থেকে মুক্তি পাওয়া ২) ভূগর্ভ জলস্তর বৃদ্ধি পাওয়া এবং সারা বছর সেই জল ব্যবহার করতে পারা।
সরকারি উদ্যোগ
দীর্ঘ আলোচনার পর পশ্চিমবঙ্গ সরকার সারা রাজ্যে প্রয়োজন অনুসারে রিচার্জ ওয়েল বা পারপোরেশন ট্যাঙ্ক বানাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই প্রকল্পের দায়িত্বে রয়েছে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর। জলস্তর নির্দিষ্ট করার জন্যে সমীক্ষা করতে সেন্ট্রাল গ্রাউন্ড ওয়াটার বোর্ডকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রথমে পুরুলিয়া তারপর মেদিনীপুরে এই কাজ হবে। মানে সারা পশ্চিমাঞ্চলের শুকনো অঞ্চলগুলিতে এই প্রকল্প চালু করে দেওয়া হচ্ছে। সমস্যাবহুল জায়গায় এই প্রকল্প খুব শিগগিরই বাস্তবায়িত করার দরকার রয়েছে। তাহলে পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষ জল সংকট থেকে রেহাই পেতে পারেন। না হলে দুর্ভোগ ক্রমেই বাড়বে।
(লেখক ইঞ্জিনিয়ার ও পরিবেশকর্মী)