Share it

তরুণ সরকার, বিষয়বস্তু বিশেষজ্ঞ (শস্যবিজ্ঞান): আধুনিক জীবনে সুস্থ থাকতে আমরা সবাই চেষ্টা করি পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করতে। এই ক্ষেত্রে চিয়া বীজ সারা বিশ্বব্যাপী এখন বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু চিয়া বীজের গুরুত্ব কী? এর ইতিহাস কী? কীভাবে এটি আমাদের স্বাস্থ্যের উপকার করে? অধিকাংশ মানুষ এখনো অবধি এই বিষয়ে ওয়াকিবহাল নয়।
ইতিহাস ও উৎপত্তিঃ
চিয়া বীজের (Chia Seed) ইতিহাস প্রায় ৫৫০০ হাজার বছরের পুরানো। মধ্য আমেরিকা, বিশেষত মেক্সিকো এবং গুয়েতমালাতে চিয়া বীজের উৎপত্তিস্থল। ঐতিহ্যগতভাবে, চিয়াবীজ প্রাচীন “আজটেক ও মায়া সভ্যতার” মানুষের খাদ্যতালিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হওয়ার সাথে সাথে ওষুধ ,প্রসাধনী ও ক্যানভাস তৈরিতেও ব্যবহার করা হতো । কলম্বিয়ান সমাজে প্রাগৈতিহাসিক সময়ে, এটি মটরশুটির পরে দ্বিতীয় প্রধান ফসল ছিল। ঐতিহ্যবাহী মায়া ভাষায় “চিয়া” শব্দটি “তেল” অথবা “শক্তি”র সাথে সম্পর্কিত বলে মনে করা হয় এবং এই বীজ ধর্মীয় আচারের অংশ ছিল। আজটেকরা বিশ্বাস করত যে চিয়া বীজ তাদের যোদ্ধাদের শক্তি এবং ধৈর্য্য অর্জনে সাহায্য করে। তাই একে ঈশ্বরের আশীর্বাদ বলে মনে করা হতো। চিয়া বীজ তার বিশাল পুষ্টি এবং থেরাপিউটিক সম্ভাবনার কারণে হাজার হাজার বছর ধরে অনেক দেশে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হত।
চিয়া বীজ এক সময়ে পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাওয়ার কারণ কি ছিল?
প্রাচীন মায়ান এবং অ্যাজটেক সভ্যতায় অত্যন্ত জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও, ছোট্ট কিন্তু অত্যন্ত পুষ্টিকর এই বীজটি, এক সময় পৃথিবীর বুক থেকে প্রায় হারিয়েই গিয়েছিল। প্রথমত, ১৬ শতকের শেষভাগে স্প্যানিশরা মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায় আগ্রাসন শুরু করার পর, এই অঞ্চলের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তিত হয়, তারা স্থানীয় সংস্কৃতি এবং আচার-অনুষ্ঠান ধ্বংস করার চেষ্টা করে। তারা বিশ্বাস করত যে, চিয়া বীজ স্থানীয় আদিবাসীদের ধর্মীয় আচার- অনুষ্ঠান ও উৎসবের সাথে যুক্ত, তাই এটি তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের বিরুদ্ধে। স্প্যানিশদের নিষেধাজ্ঞার ফলে চিয়া বীজের চাষ এবং ব্যবহার ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। এছাড়াও, চিয়া বীজের পরিবর্তে স্প্যানিশরা অন্যান্য অর্থকরী ফসল যেমন ধান, গম,ভুট্টা, আখ এবং কফি চাষে বেশি গুরুত্ব দেয়। ফলে,স্থানীয় ফসলের উপর এর সরাসরি প্রভাব পড়ে। চিয়া বীজের চাষাবাদ ধীরে ধীরে কমে যায়, একসময় প্রায় হারিয়ে যায় কারণ নতুন অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কাঠামোতে এর প্রয়োজনীয়তা হ্রাস পায়।
দ্বিতীয়ত, উপনিবেশ স্থাপনের পরবর্তী সময়ে, স্থানীয় খাদ্যাভ্যাস এবং চাষাবাদ পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটে। স্প্যানিশরা তাদের নিজেদের কৃষি পদ্ধতি এবং ফসলের প্রচলন ঘটায়, যা স্থানীয় ফসলকে প্রান্তিক করে তোলে। চিয়া বীজের উচ্চ পুষ্টিগুণ থাকা সত্ত্বেও, এটি কম গুরুত্ব পেতে থাকে এবং একসময়ে প্রায় বিলুপ্তির পথে চলে যায়। কিছু বিশেষজ্ঞের মতে জলবায়ু পরিবর্তন এবং আধুনিক খাদ্যের প্রভাবও এর পতনের কারণ হিসেবে কাজ করেছে।
তবে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে এবং একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে পুষ্টি বিজ্ঞান এবং স্বাস্থ্য সচেতনতায় বিপ্লব ঘটে। আধুনিক গবেষক এবং পুষ্টিবিদরা চিয়া বীজের অসাধারণ পুষ্টিগুণ সম্পর্কে পুনরায় সচেতন হন এবং এর ব্যবহার আবার জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এখন, চিয়া বীজ সুপারফুড হিসেবে বিশ্বজুড়ে পরিচিত এবং এর চাষাবাদ ও ব্যবহার পুনরায় বৃদ্ধি পাচ্ছে।
চিয়া বীজের এই পুনর্জাগরণ আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সুপারফুডের গুরুত্ব অপরিসীম। এটি প্রমাণ করে যে, সঠিক পুষ্টি এবং স্বাস্থ্যবিধির গুরুত্ব কখনও হ্রাস পায় না, বরং সময়ের সাথে সাথে নতুনভাবে আবিষ্কৃত হয়।
চিয়া বীজের পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা:
চিয়া বীজের ক্ষুদ্রাকৃতির মধ্যে রয়েছে প্রচুর পুষ্টিগুণ। এতে ফাইবার, প্রোটিন, ওমেগা-3 ফ্যাটি অ্যাসিড, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়ামের মতো খনিজ উপাদানে ভরপুর আছে। এই উপাদানগুলো আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখতে বিভিন্নভাবে সাহায্য করে।
পুষ্টিগুণ:
ফাইবার: চিয়া বীজে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকে, যা হজমশক্তি উন্নত করতে, ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে এবং কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে।
প্রোটিন: চিয়া বীজ উদ্ভিদ ভিত্তিক প্রোটিনের একটি ভালো উৎস, যা এটিকে নিরামিষভোজী এবং শাকাভোজীদের জন্য একটি চমৎকার খাদ্য করে তোলে।
ওমেগা-3 ফ্যাটি অ্যাসিড: চিয়া বীজ ওমেগা-3 ফ্যাটি অ্যাসিডের একটি সমৃদ্ধ উৎস, যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে, মস্তিষ্কের কার্যকারিতা উন্নত করতে এবং প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট: চিয়া বীজ অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে সমৃদ্ধ, যা কোষের ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
খনিজ পদার্থ: চিয়া বীজে বিভিন্ন খনিজ পদার্থ থাকে, যার মধ্যে রয়েছে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, লোহা এবং ফসফরাস।
উপকারিতা:
হজম উন্নত করে: চিয়া বীজের ফাইবার হজমশক্তি উন্নত করতে, কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করতে এবং নিয়মিততা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে: চিয়া বীজের ফাইবার এবং প্রোটিন আপনাকে দীর্ঘ সময় ধরে পূর্ণ রাখতে পারে, যা ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে।
হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়: চিয়া বীজের ওমেগা-3 ফ্যাটি অ্যাসিড রক্তের ট্রাইগ্লিসারাইড এবং খারাপ কোলেস্টেরল (LDL) কমাতে সাহায্য করে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে পারে
মস্তিষ্কের কার্যকারিতা উন্নত করে: চিয়া বীজের ওমেগা-3 ফ্যাটি অ্যাসিড মস্তিষ্কের কার্যকারিতা উন্নত করতে এবং স্মৃতিশক্তি এবং মনোযোগ বৃদ্ধি করতে সাহায্য করতে পারে।
প্রদাহ কমায়: চিয়া বীজের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে, যা গর্ভাশয়ের ক্যান্সার, হৃদরোগ এবং অন্যান্য রোগের ঝুঁকি কমাতে পারে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে: চিয়া বীজ রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে, যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উপকারী হতে পারে।
ত্বক ও চুলের স্বাস্থ্য উন্নত করে: চিয়া বীজের ওমেগা-3 ফ্যাটি অ্যাসিড ত্বক ও চুলের স্বাস্থ্য উন্নত করতে সাহায্য করে।

চিয়া বীজের পুষ্টিমুল্যঃ
ক্রমিক নং পুষ্টি প্রতি ১০০ গ্রাম
১। শক্তি (কিলো ক্যালোরি) ৪৮৬
২। প্রোটিন (গ্রাম) ১৬.৫৪
৩। টোটাল ফ্যাট (গ্রাম) ৩০.৭৪
৪। সম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড (গ্রাম) ৩.৩৩
৫। মনো সম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড (গ্রাম) ২.৩১
৬। পলি সম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড (গ্রাম) ২৩.৬৭
৭। ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড (গ্রাম) ০.১৪
৮। ওমেগা-3 ফ্যাটি অ্যাসিড, (গ্রাম) ১৭.৮৩
৯। কোলেস্টরল (মিলি গ্রাম) ০.০০
১০। কার্বোহাইড্রেট (গ্রাম) ৪২.১২
১১। ফাইবার, টোটাল ডায়েটরি (গ্রাম) ৩৪.৪০
সূত্রঃ U.S. Department of Agriculture (2011)
চিয়া বীজে খনিজ লবনের পরিমানঃ
ক্রমিক নং খনিজ লবন গড় পরিমান (মিগ্রা / ১০০০ গ্রাম)
১। পটাশিয়াম ৪০৭
২। ম্যাগনেশিয়াম ৩৩৫
৩। ক্যালশিয়াম ৬৩১
৪। ফসফরাস ৮৬০
৫। কপার ১৩.৮৮
৬। ম্যাংগানিজ ২৬.৯২
৭। আয়রণ ৯৯.৭২
৮। জিঙ্ক ৫২.৪৪
সূত্রঃ Kulkarni et at.,(2020)
চাষ পদ্ধতিঃ ২০১২ সালে প্রথম Central Food technological Research institute, Mysore ভারতের জলবায়ুর আঙ্গিকে চিয়ার কিছু জাত নির্বাচন করেন। এবং ২০১৩-১৪ সালে কর্ণাটকের কৃষকদের মধ্যে এর বীজ বিতরণ করার মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষে প্রথম চিয়ার অর্থনৈতিকভাবে চাষ শুরু হয়। বর্তমানে কর্ণাটকসহ, উত্তরপ্রদেশ ,রাজস্থান,তামিলনাডুর বিভিন্ন কৃষকেরা এই ফসলের অর্থনৈতিকভাবে চাষাবাস শুরু করেছেন। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ এবং নদীয়া জেলার কিছু অঞ্চলে ইতিমধ্যে এর চাষ প্রচলন হয়েছে।
উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্য: চিয়া বীজ, সালভিয়া হিস্পানিকা (Salvia hispanica L.,) উদ্ভিদ থেকে আসে, এটি পুদিনা পরিবারের অন্তর্গত। চিয়া গাছ লম্বা (সর্বোচ্চ ১-২ মিটার অবধি), একক-কক্ষযুক্ত বা unifoliate গুল্ম। ফুলগুলি নীল, বেগুনি, বেগুনি-সাদা, ২-৩ সেমি লম্বা, থোপায় থোপায় বিন্যাস্ হয়। সাধারণত ঠান্ডা এবং শুষ্ক জলবায়ুতে চিয়া গাছ ভালো জন্মায়। চিয়ার বীজগুলি সাধারণত ধূসর ,কালো, বাদামি এবং সাদা রঙের দেখা যায়।
জলবায়ুঃ চিয়া (Salvia hispanica) উষ্ণমন্ডলীয় এবং উপ-উষ্ণমন্ডলীয় অঞ্চলে ভালোভাবে বৃদ্ধি পায়। এটি উষ্ণ তাপমাত্রা, যা ১৫°C থেকে ৩৮°C পছন্দ করে। চিয়া গাছ বিভিন্ন আবহাওয়াতে সহনশীল হলেও ভালো জল নিষ্কাশনযুক্ত মাটি এবং রৌদ্রোজ্জ্বল স্থান থেকে় ভালো ফলন পাওয়া যায়।
মাটিঃ চিয়া বেলে দোঁআশ থেকে দোঁআশ মাটিতে ভালোভাবে বৃদ্ধি পায় যার ভালো জল নিষ্কাশন ব্যবস্থা থাকে। চিয়া চাষের জন্য আদর্শ পিএইচ রেঞ্জ হল ৬ থেকে ৮। মাটির উর্বরতা মাঝারি হওয়া উচিত, কারণ অতিরিক্ত সমৃদ্ধ মাটি অতিরিক্ত উদ্ভিজ্জ বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করতে পারে যা বীজ উপাদনের ক্ষতি করতে পারে।
বীজরোপণ এবং স্থান নির্ধারণঃ চিয়া বীজ ছোট এবং রোপণের আগে কোন বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন হয় না। সরাসরি মাটিতে ছিটিয়ে বপন সবচেয়ে সাধারণ পদ্ধতি, তবে সারিতে বপনও করা হয়। কিছুক্ষেত্রে চারা রোপণও করা হয়।
রোপণের সময়ঃ উষ্ণমন্ডলীয় অঞ্চলে, এটি সারা বছর রোপণ করা যেতে পারে। ভারতবর্ষে সাধারণত অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকে নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ চারা রোপণ করার উপযুক্ত সময়। কোন কৃষকবন্ধু যদি বছরে দুবার চাষ করতে আগ্রহী হন তবে জানুয়ারি মাসে রোপণ করলেও ভালো ফলন পেতে পারেন।
বীজের হারঃ বিঘাপ্রতি বীজের হার ৮০০ গ্রাম থেকে ১ কেজি মতন (৩৩ শতকে বিঘা হিসাবে)
স্থান নির্ধারণঃ বীজ সর্বদা পাতলা করে বপন করে হালকা মাটির স্তর দিয়ে আচ্ছাদিত করা উচিত, প্রায় ১/৮ ইঞ্চি গভীর। সারিগুলিকে ৫০ থেকে ৬০ সেমি দূরত্বে এবং গাছগুলিকে ২৫ থেকে ৩০ সেমি দূরত্বে পাতলা করে রোপণ করলে গাছের সঠিক বৃদ্ধি এবং বায়ু সঞ্চালনের সুবিধা হয়।
সেচঃ চিয়া গাছের অঙ্কুরোদগম এবং প্রাথমিক বৃদ্ধির পর্যায়ে নিয়মিত জল দেওয়ার প্রয়োজন হয়। তবে, একবার প্রতিষ্ঠিত হলে, তারা আপেক্ষিকভাবে খরাপ্রবণ। অতিরিক্ত জল গাছের পক্ষে ক্ষতিকারক কারণ চিয়া গাছ জলাবদ্ধ অবস্থায় ভালো বৃদ্ধি পায় না। তবে বীজ রোপণের ১৫ দিনের মাথায় একবার সেচ দিলে গাছের দ্রুত বৃদ্ধি ঘটে।
সার প্রয়োগঃ চিয়া গাছে খুব অল্প সারের প্রয়োজন হয়়। রোপণের সময় এবং একবার গাছের বৃদ্ধির সময় একটি সুষম সার প্রয়োগ করা যেতে পারে। অতিরিক্ত নাইট্রোজেন এড়িয়ে চলতে হবে, কারণ এটি বীজ উৎপাদনের পরিবর্তে উদ্ভিজ্জ বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করতে পারে। বিঘাপ্রতি ২০ কেজি সিঙ্গেল সুপার ফসফেট, ৬ কেজি ইউরিয়া, ৬ কেজি পটাশ যথেষ্ট । তবে নাইট্রোজেন ঘটিত সার দুটি সমানভাগে প্রয়োগ করলে ভালো হয়। একভাগ বীজবপনের সময় বাকি অর্ধেক বীজ বপনের ৩০ দিন পর । জৈব সার হিসাব কেঁচোসার কিংবা কম্পোস্ট সার বিঘাপ্রতি ৮০০ কেজি থেকে ১ টন ব্যবহার করা যেতে পারে।
কীটপতঙ্গ এবং রোগ ব্যবস্থাপনাঃ
কীটপতঙ্গঃ চিয়া গাছ আপেক্ষিকভাবে কীটপতঙ্গ প্রতিরোধী,চিয়া গাছের পাতায় অপরিহার্য এমন কিছু তৈলাক্ত পদার্থ এবং গন্ধ রয়েছে যা পোকামাকড়ের আক্রমণে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তবে মাঝে মাঝে এফিডস, মাইট এবং সাদামাছি দ্বারা গাছ আক্রান্ত হতে পারে। নিয়মিত পর্যবেক্ষণ এবং জৈব কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি, যেমন নিম তেল বা কীটনাশক সাবান, সংক্রমণ মোকাবেলায় সহায়তা করতে পারে। তাই চিয়া কীটনাশক ছাড়াই নিরাপদে চাষের জন্য উপযুক্ত।
রোগঃ চিয়া সাধারণত রোগ প্রতিরোধী, তবে এটি অত্যধিক ভেজা অবস্থায় ছত্রাকঘটিত রোগের জন্য সংবেদনশীল হতে পারে। সঠিক স্থান নির্ধারণ, ভাল বায়ু সঞ্চালন, এবং ওভারহেড জল দেওয়া এড়িয়ে চলা রোগের প্রাদুর্ভাব প্রতিরোধে সহায়তা করতে পারে।
আগাছা নিয়ন্ত্রণঃ
চিয়া উদ্ভিদকে আগাছার প্রতিযোগিতা থেকে রক্ষা করতে নিয়মিত আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। মাটির আর্দ্রতা বজায় রাখতে এবং আগাছা নিয়ন্ত্রণ করতে মাটি আচ্ছাদন করার জন্য খড়, শুকনো পাতা বা প্লাস্টিক শীট ব্যবহার করা যেতে পারে।
অন্যান্য ফসলের সাথে চিয়া এর আন্তঃফসলঃ
চিয়ার সাথে আন্তঃফসলের জন্য উপযুক্ত ফসল হল ভুট্টা, সয়াবিন, তুলা, মেথি, সবজি যেমন অ্যামারান্থাস, মূলা, ধনিয়া, পালং শাক।
সংগ্রহ এবং প্রক্রিয়াকরণঃ
ফসল কাটার সময়ঃ চিয়া গাছ রোপণের ৪০ দিন পর থেকে গাছে ফুল আসতে শুরু করে , একটা গাছে ৮-১২ টির মতন কুঁড়ি আসে যা পরে শিষে পরিনত হয়। রোপণের ৯০ দিন পর থেকে শিষ শুকিয়ে মাথাগুলি বাদামী হয়ে গেলে ফসল কাটার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। এই প্রক্রিয়াটি রোপণের ৯০-১২০ দিন মধ্যে ঘটে।
ফসল কাটার পদ্ধতিঃ গাছগুলি গোড়ায় কাটা হয় এবং ত্রিপল বা পরিষ্কার মেঝেতে মাঠে কয়েকদিনের জন্য শুকোতে দেওয়া হয়। ১২ -১৫ দিন রোদ খাওয়ানোর পর একবার শুকিয়ে গেলে, বাঁশ বা লাঠি দিয়ে হালকাভাবে আঘাত করলেই গাছ থেকে বীজ আলাদা হয়ে যায়। চাষের স্কেলের উপর নির্ভর করে, থ্রেশিং ম্যানুয়ালি বা যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ব্যবহার করে করা যেতে পারে।
পরিষ্কার এবং স্টোরেজঃ থ্রেশিংয়ের পরে, বীজগুলির ধ্বংসাবশেষ এবং খড় অপসারণের জন্য পরিষ্কার করা উচিত। পরিষ্কার চিয়া বীজ তাদের গুণমান বজায় রাখতে এবং শেল্ফ লাইফ বাড়ানোর জন্য একটি শীতল, শুষ্ক জায়গায় সংরক্ষণ করা উচিত।
চিয়া চাষের সম্ভাব্য খরচঃ চাষের পদ্ধতি এবং ভৌগোলিক অঞ্চলভেদে চিয়ার ফলন বিঘাপ্রতি (৩৩ শতক হিসাবে) ১ থেকে ১.৫ কুইন্টাল। বিঘাপ্রতি এই ফসল চাষে খরচ পরে প্রায় ৬৫০০ থেকে ৭০০০ টাকা। বর্তমানে প্রতি কেজি চিয়া বীজের বাজার মূল্য প্রায় ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা বলে জানা গিয়েছে।
পরিশেষে বলা যেতে পারে চিয়া একটি উচ্চ মূল্যের ফসল হিসেবে গণ্য হওয়ায় এই ফসলের চাষ অনেক লাভজনক। ভারতের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে কৃষির বহুমুখীকরণের ক্ষেত্রে চিয়া বীজের চাষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করবে। এই ফসল পুষ্টি নিরাপত্তায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। তাই উদ্যোগী ছোট-বড় কৃষকভাইদের কাছে চিয়া বীজের চাষ হয়ে উঠতে পারে এক সম্ভাবনাময় বিকল্প।
(লেখক পরিচিতি: তরুণ সরকার, বিষয়বস্তু বিশেষজ্ঞ (শস্যবিজ্ঞান), পূর্ব মেদিনীপুর কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র,বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়)

Share it