Dr Bidhan Chandra Roy
Share it

সাধনা নাথ: ১৮৮২ সালে জন্ম এবং ১৯৬২ সালে মৃত্যু। জন্ম ও মৃত্যু দুটিই ১ জুলাই। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের ভাষায় “জন্ম-মৃত্যু একাসনে দোঁহে বসিয়াছে”। বিধানচন্দ্র রায় আজীবন কাজ করে গেছেন এমনকী মৃত্যুর দিনেও তিনি কাজ করতে করতেই চিরকালের জন্য স্তব্ধ হয়ে যান। তাঁর এই কাজ কিন্তু নিজের জন্য নয়। পুরোটাই করেছেন দেশ এবং দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থে। একদিকে তিনি যেমন ছিলেন দক্ষ দেশনেতা, রাজনীতিবিদ এবং কিংবদন্তি তুল্য চিকিৎসক। অথচ এসব কিছুই তাঁর করার কথা ছিল না। বাবা প্রকাশ চন্দ্র রায় এবং মা অঘোর কামিনী দেবী ছিলেন মূলত ব্রাহ্ম ধর্মের প্রচারক। শিবনাথ শাস্ত্রীর সঙ্গে তরুণ প্রকাশ চন্দ্র বহু জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন ব্রাহ্ম ধর্মের প্রচারের জন্য। অঘোর কামিনী দেবীও ছিলেন স্বামীর যোগ্য সহযোগী।

বিধানচন্দ্র রায় না চিকিৎসক হতে চেয়েছিলেন, না হতে চেয়েছিলেন রাজনৈতিক নেতা। প্রথম জীবনে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার দিকেই ঝোঁক ছিল তাঁর। কিন্তু বি.এ. পাশ করার পর তিনি চিকিৎসা শাস্ত্রের দিকে ঝোঁকেন এবং উপযুক্ত ডিগ্রিও পান। পরে ইংল্যান্ডে গিয়ে আরও বড় স্বীকৃতি নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু ১৯৪৭ দেশ ভাগের সময় তিনি বিদেশে চিকিৎসা শাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনায় ব্যস্ত ছিলেন। মহাত্মা গান্ধী ও জওহরলাল নেহরুর ডাকে খণ্ডিত ভারতে ফিরে আসেন। এবং তাঁদেরই অনুরোধে নবগঠিত রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্ব নেন। এর আগে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ডক্টর প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ। কিন্তু, নতুন রাজ্যের সমস্যা সম্ভবত তিনি ঠিক মতো বুঝে উঠতে পারেননি বলে এখানকার সংকট আরও বেড়ে যায়। কারণ এ সময় পূর্ব পাকিস্তান থেকে বহু হিন্দু উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে চলে আসেন এবং এরাজ্যে নতুন অর্থনীতির ওপর তার ফলে প্রবল চাপ তৈরি হয়। বিধানচন্দ্র রায় এই চাপ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সামলেছেন এবং এই রাজ্যকে সমৃদ্ধি ও সুষ্ঠু পথে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। সেকারণে ডক্টর বিধানচন্দ্র রায় এবং পশ্চিমবঙ্গকে সমার্থক বলে মনে করা হয়। এক হিসেবে তিনি এই রাজ্যের আদর্শ পথিকৃত।

এই কথাটি যত সহজে বলা যায় সেই সময়ে দাঁড়িয়ে তত সহজ ছিল না। হাজার হাজার উদ্বাস্তু এদেশে এসে নিজেদের মতো করে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছিলেন। ফলে এখানে যেমন জমির ওপর প্রচন্ড চাপ পড়ে তেমনই আর্থ-ব্যবস্থাও তছনছ হয়ে যায়। বিধানচন্দ্র তা সামাল দেওয়ার জন্যে কয়েকটি পদক্ষেপ নিলেন। তৈরি করলেন ক্যালকাটা স্টেট ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশন, মাদার ডেয়ারি, দুর্গাপুর ও কল্যাণীর মতো দুটি নতুন শহর। এই শহরগুলি মূলত শিল্প এলাকা হিসেবেই চিহ্নিত করেন তিনি। দুর্গাপুরে তৈরি হয় দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্ট এবং তার অনুসারী নানা শিল্প কারখানা। পরে আরও কয়েকটি বড় কারখানা এসে এখানে তাদের কাজ শুরু করে। কল্যাণীতেও তিনি নানা শিল্প স্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন তবে তা দুর্গাপুরের মতো উৎপাদন কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারেনি। যদিও এখানে তৈরি করেছিলেন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়। যেখানে মূলত কৃষি বিজ্ঞান নিয়েই পড়াশোনা হওয়ার কথা ছিল। এছাড়া হস্তান্তর হয়ে যাওয়া জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি পুনরুদ্ধার করেন এবং সেখানে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করেন। তাঁর সময়েই বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়েরও সূচনা হয়। একারণে বর্ধমান রাজবাড়িটি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। তাঁরই উদ্যোগে দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনের বাঁধ তৈরি হয় দুর্গাপুরে। পরে গঙ্গার বন্যা নিয়ন্ত্রণে ফারাক্কাতেও একটি বাঁধ তৈরি হয়েছিল। ফলে বিধানচন্দ্রকে কেবল রাজনীতিবিদ বললে ভুল হবে, তিনি বঙ্গের সংস্কৃতি এবং শিল্পকেও ওপরে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। স্টেট ট্রান্সপোর্ট এবং মাদার ডেয়ারিতে মূলত উদ্বাস্তু যুবক যুবতিদের কাজ দিয়েই তিনি আর্থিক পরিস্থিতি সামাল দিতে পেরেছিলেন।

এর চেয়েও বড় কথা তিনি ছিলেন এক মহান চিকিৎসক। কেবল মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু সহ বিভিন্ন কেন্দ্রীয় নেতাদের স্বাস্থ্য দেখভালই তিনি করতেন না, তাঁর চিকিৎসা ব্যাপারে অনেকটা সময় কাটত মূলত গরিব-গুর্বো মানুষজনকে বিনামূল্যে চিকিৎসা দিয়ে এবং সে চিকিৎসা ছিল অব্যর্থ। শোনা যায় কোনও রোগীকে দেখেই তিনি বলতে পারতেন তাঁর কী রোগ। এবং চিকিৎসা পদ্ধতিও ছিল অতি সরল। কোনও দামি ওষুধও তিনি লিখতেন না বরং খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারেও উপযুক্ত পরামর্শ দিতেন। তবে এরাজ্যে ওষুধ তৈরির নতুন কারখানা স্থাপনে যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন। সে কারণে এই সময় পশ্চিমবঙ্গ থেকে অনেক প্রয়োজনীয় ওষুধ বাইরেও সরবরাহ করা হত। পাশাপাশি আকাশ পথে ভূমি ও মাটি পর্যবেক্ষণের জন্য এবং যথার্থ মানচিত্র নির্মাণের কাজে লাগবে এমন একটি কম্পানি তৈরিতে সাহায্য করেছিলেন। বর্তমানে অবশ্য সে কম্পানিটি বন্ধ হয়ে গেছে। ওই ধরনের কাজগুলি অন্য রাজ্যে চলে গেছে। ডক্টর বিধানচন্দ্র রায় সম্পর্কে এইসব কথা বললেই শেষ হয়ে যায় না। তিনি ঠিক সময়ে যদি পশ্চিমবঙ্গের হাল না ধরতেন তাহলে আমাদের অবস্থান যে ঠিক কী হত তা ভাবলেও আতঙ্কিত হতে হয়।
(লেখক কবি ও নারী সংগঠক)

Share it