দিলীপ চক্রবর্তী : বর্তমান রাজনৈতিক কালপর্বে রাজনৈতিক নেতা সীতারাম ইয়েচুরির জীবনাবসান দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে প্রচণ্ড আঘাত হিসেবে চিহ্নিত হবে। সীতারাম ইয়েচুরি সিপিআইএম দলের রাজ্যসভার সাংসদ এবং সিপিআইএম দলের সর্বভারতীয় সম্পাদক হিসেবে বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন – শুধুমাত্র একথা লিখলে অন্যায় হবে। দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে তিনি আমাদের দেশে স্বৈরাচার এবং ফ্যাসীবাদের বিরুদ্ধে সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর নিজ দল সিপিএমের মধ্যেও রক্ষণশীল এবং সংকীর্ণতাবাদী শক্তিগুলি তাঁর এই উদ্যোগে বাধা সৃষ্টি করলেও তিনি তাঁর দিশায় অবিচল থেকেছেন। হঠাৎ মৃত্যু এসে তাঁর জীবন কেড়ে নেওয়ায় এই প্রগতিশীল আন্দোলনের অপূরণীয় ক্ষতি হল।
সীতারাম ইয়েচুরির জন্ম ১৯৫২ সালে। তিনি উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়েছিলেন। পরবর্তীকালেও তাঁর পরীক্ষার ফলাফল অত্যন্ত আকর্ষণীয়। কিন্তু পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি রাজনীতিতেও আকৃষ্ট হন। দিল্লিতে এসে জেএনইউ-তে অধ্যয়ণকালে তিনি ছাত্র রাজনীতির শীর্ষে ওঠেন। তিনি একাধিকবার জেএনইউ-র ছাত্র সংসদের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। এতেই ছাত্র সমাজে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা পরিলক্ষিত হয়। ওই সময়ে প্রকাশ কারাট ছিলেন জেএনইউ-তে সিপিআইএম দলের ছাত্র সংগঠন এসএফআই-এর সম্পাদক। ১৯৭৫ সালে সীতারাম সিপিআইএম দলের সদস্যপদ লাভ করেন। সীতারাম ইয়েচুরি রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝেছিলেন মার্কসবাদ একটি বিজ্ঞান। সৃজনশীল বিজ্ঞান। এটা রক্ষণশীল সংকীর্ণতাবাদে ঘেরা ধর্মশাস্ত্র নয়। আধুনিকতা ও প্রগতি মার্কসবাদ বহন করে। ভারতের প্রথম সোনিয়া গান্ধী, মনমোহন সিং নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারকে সিপিআইএম ও বামপন্থীরা বাইরে থেকে সমর্থন করেছিল। ওই সময়ে ওই সরকারের উপরে প্রয়োজনীয় চাপ সৃষ্টি করতে পেরেছিল বামপন্থা। প্রথম ইউপিএ সরকার ওই কালপর্বে বেশ কিছু জনহিতকর ও শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থে কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। ইউপিএ প্রথম সরকারকে সিপিএম ও বামপন্থীদের সমর্থনের বিষয়ে হরকিষণ সিং সুরজিৎ, জ্যোতি বসু, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখের সঙ্গে সীতারাম ইয়েচুরিরও সদর্থক ভূমিকা ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে প্রকাশ কারাট সিপিএম দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর মনমোহন সিং নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার থেকে সিপিআইএম ও বামপন্থীরা সমর্থন প্রত্যাহার করে। ওই সময়ে মনমোহন সিং সরকারের অবসানের জন্য বকলমে বিজেপি-কেও বামপন্থীরা সাহায্য করে। ফলে ওই কালপর্বে কংগ্রেসের মধ্যে বাম ঘেঁষা দক্ষিণপন্থার প্রভাব বৃদ্ধি হয়। প্রকাশ কারাটের নেতৃত্বে সিপিএমের এই কর্মসূচিতে কংগ্রেসের অভ্যন্তরে বাম ঘেঁষা মধ্যপন্থার প্রভাব কমে। যা দেশের প্রগতির পক্ষে সহায়ক ছিল না। কার্যত কেন্দ্রের কংগ্রেস রাজের অবসান হয়। এবং আমাদের এই রাজ্যেও বামপন্থী এবং মধ্যপন্থার কংগ্রেসের প্রভাব কমে দক্ষিণপন্থার শক্তি বৃদ্ধি হয়।
আমার সঙ্গে সীতারামের পরিচয় ১৯৮২ সালে দিল্লিতে। তখন তিনি ৩০ বছরের যুবক। ওই বয়সে সিপিএম দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে আছেন। আমি সবে ৪০ অতিক্রম করেছি। আমি কমিউনিস্ট সাংবাদিক হলেও তখন সিপিআই দলের বৃত্তের বাইরে। কমিউনিস্ট নেতা এস এ ডাঙ্গের নেতৃত্বে এআইসিপি-র একজন অংশীদার। দিল্লির সাংবাদিক সুমিত চক্রবর্তী এবং আমি একসঙ্গে দিল্লিতে গিয়েছিলাম এ কে গোপালন ভবনে। রাজনীতি নিয়ে জমিয়ে কথা হল। তাঁর কথায় কিন্তু কোনও সংকীর্ণতা এবং বিদ্বেষ নেই। আমি ভিন্ন মতের লোক হলেও তিনি যথেষ্ট মর্যাদা দিয়েই আমার সঙ্গে কথা বলেন। এরপরেও তাঁর সঙ্গে বেশ কয়েকবার আমার দেখা হয়েছে। দেখা হলেই সুন্দর ব্যবহার করেছেন। তাঁর এই সুন্দর ব্যবহার এবং অন্যের মত ধৈর্য ধরে শোনা এবং নিজের মত ধৈর্য ধরে ব্যাখা করার বাচনভঙ্গি এমনকী দাঁর বিরোধী মতের লোকদেরও আকৃষ্ট করেছে।
ইয়েচুরি অনুভব করেছিলেন যে বর্তমান সময়ে দেশের সবচাইতে ক্ষতিকারক শক্তি হচ্ছে বিজেপি। যে দল ভারতবর্ষের ইতিহাসকে ভিন্নপথে পরিচালিত করতে যাচ্ছে এবং ভারতের অর্থনীতিকে সম্পূর্ণভাবে ধনবাদের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করতে চায়। যে দল ফ্যাসিবাদী দর্শনকে ভারতবর্ষের সংস্কৃতি, রাজনীতি ও অর্থনীতির উপর বসাতে যায়। তাই এই দর্শনের বিরুদ্ধে এবং এই সরকারের বিরুদ্ধে সার্বিক ঐক্য গড়ার জন্য ইন্ডিয়া জোট করতে হবে। তিনি সিপিআইএমের তীব্র কংগ্রেস বিরোধিতার অতীতের লাইন থেকে পার্টিকে সরিয়ে এনে কংগ্রেসর সঙ্গে ঐক্য ও সংগ্রামের নীতির ভিত্তিতে অগ্রসর হতে চেয়েছেন। দেশের বামপন্থা এবং বাম ঘেঁষে মধ্যপন্থাকে অগ্রসর করতে চেয়েছেন। বুঝতে পেরেছিলেন এতবড় ভারতবর্ষে কংগ্রেস নিশ্চিহ্ন হলে দক্ষিণপন্থা বাড়বে বামপন্থা নয়। আবার বামপন্থা ধ্বংস হলেও কংগ্রেসের শক্তি বৃদ্ধি হবে না, দক্ষিণপন্তার শক্তি বৃদ্ধি হবে। এর ভিত্তিতেই তিনি অগ্রসর হয়ে কংগ্রেসের অন্যতম নেতা রাহুল গান্ধির সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি করেছিলেন। এবং ধর্ম নিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দলগুলির সঙ্গে ঐক্য গড়ার নীতিতে অগ্রসর হচ্ছিলেন। এরফলে তাঁর মৃত্যুতে এই প্রয়াসেরই ক্ষতি হল।