দিলীপ চক্রবর্তী, কলকাতা: এই পৃথিবীতে একটি নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। সেটি আমাদের প্রতিবেশী দেশ স্বাধীন বাংলাদেশ। আমাদের দুই দেশের রক্তের রাখি বন্ধনে জন্ম নিয়েছিল এই দেশ। ওই কালপর্বে এই স্বাধীনতার জন্য যেমন বাংলাদেশের মানুষ রক্ত দিয়েছেন অত্যাচার সহ্য করেছেন তেমনি আমাদের দেশের মানুষও রক্ত দিয়েছে। ওই দেশের এক কোটি মানুষের সঙ্গে আমাদের দেশের মানুষ ভাত ভাগ করে খেয়েছে। কারণ ওই সময় পাক বাহিনীর অত্যাচারে এক কোটি মানুষ এসে আশ্রয় নিয়েছিল আমাদের দেশে। তরুণ সাংবাদিক হিসেবে আমি ওই মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি। জীবন বিপন্ন করে পূর্ব বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ছুটে গিয়েছি এবং রণাঙ্গনে রিপোর্ট করেছি। আমি জন্মাতে দেখেছি এক স্বাধীন দেশকে। এই দিনটি পালিত হয়
বিজয় দিবস হিসাবে।
ওই বিজয় দিবসের দিনটিতে আমি অবশ্য ঢাকায় যেতে পারিনি তার কয়েকদিন আগেই যশোর, খুলনা প্রভৃতি জায়গা থেকে রিপোর্ট নিয়ে আমি কলকাতায় এসেছি। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর তারিখে আমি ছিলাম কলকাতায়। আমি ওই দিনটিকে স্মরণ
করছি এদেশে ওইসময় আমার লেখা রিপোর্টারদের অংশ এখানে উল্লেখ করে: “১৪ ডিসেম্বর ভারতীয় বাহিনীর প্রধান ফিল্ড মার্শাল মানেক শ বাংলাদেশে পূর্ববঙ্গের পাক বাহিনীকে অবিলম্বে আত্মসমর্পণের জন্য বার্তা পাঠান। ওই বার্তায় বলা হয় ঢাকা
এখন সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ। অবিলম্বে আত্মসমর্পণ করুন। হাতিয়ার ফেক দো, বৃথা রক্তপাত করে আর লাভ নেই। তার মানে মার্কিন সপ্তম নৌবহর আর বঙ্গোপসাগর দিয়ে চট্টোগ্রামে পৌঁছতে পারল না। তার আগেই ঢাকা মুক্ত হতে চলেছে। সাবাশ মুক্তিবাহিনী। সাবাশ ভারতীয় জওয়ান। তবে নিয়াজি এখনও আত্মসমর্পণ করছে না কেন এই নিয়ে আমরা যারা রণাঙ্গনে রিপোর্টার ছিলাম তাদের মধ্যে কিছু আলোচনা হল। আমাদের অনেকেরই মনে হল ওরা বোধ হয় অপেক্ষা করছে শেষ মুহূর্তে হলেও আমেরিকা আর চিন হয়তো ওদের রক্ষায় সরাসরি এগিয়ে আসবে। এগিয়ে আসবে কীভাবে? তাহলে কি বিমান বাহিনী পাঠাবে? নৌবহর পাঠাবে তাহলে তো বিশ্বযুদ্ধ।
ভারত তো আর একা নয়। ভারতের বন্ধুশক্তি সোভিয়েত নৌবাহিনীও তো এখন ভারত মহাসাগরে বিরাট নৌবাহিনী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর সোভিয়েত বাহিনী পদাতিক বাহিনীও চিন সীমান্তে দাঁড়িয়ে আছে। ১৪ ডিসেম্বর বিকেল ৪টে থেকে ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টা পর্যন্ত বাংলাদেশে বিমান আক্রমণ স্থগিত রাখরা নির্দেশ দিলেন ফিল্ড মার্শাল মানেক শ। এই সময়ের মধ্যে তিনি পাক বাহিনীকে পুনরায় আত্মসমর্পণের জন্য বার্তা পাঠালেন। না হলে আবার ব্যাপক আক্রমণ হবে বলে হুঁশিয়ারি দিলেন। এরই মধ্যে খবর পেলাম বাংলাদেশে বেশ কিছু বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছে। পলায়নরত পাকিস্তানি সৈন্য এবং তাদের সাকরেদ রাজাকার, অলবদর
গোষ্ঠী ঢাকা, ব্রাহ্মণবেড়িয়া, চট্টোগ্রাম প্রভৃতি অঞ্চলে সেখানকার বিশিষ্ট অধ্যাপক, সাংবাদিক, ডাক্তার, সাহিত্যি, আইনজীবীদের ধরে নিয়ে খুন করেছে। অর্থাৎ যুদ্ধে পরাজয় বরণের আগে শেষ কামড়। ১৬ ডিসেম্বর সকাল থেকে উত্তেজনা। পাক বাহিনী আজ বিকেলে ঢাকায় আত্মসমর্পণ করবে। আমাদের কয়েকজন সাংবাদিক যারা ত্রিপুরা সীমান্তে ছিল এবং ময়মনসিং সীমান্তে ছিল তারা ঢাকা যাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমার ঢাকা যাওয়া সম্ভব হল না। কারণ আমি কলকাতায়।
বিজয়
১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হচ্ছে। ইস্, সাংবাদিক হিসেবে এই মুহূর্তে ঢাকায় থাকার আনন্দই আলাদা ছিল। কিন্তু আমার পক্ষে তা সম্ভব হল না। কলকাতায় সেনাবাহিনীর জনসংযোগ দপ্তর থেকে বিকেলে ছুটে বের হলাম। মানুষ জয়ের খবর পেয়ে গিয়েছে। রাস্তা জুড়ে হল্লা। সমস্ত কলকাতা যেন রাস্তায় নেমেছে। মানুষ চিৎকার করছে জয় বাংলা। আমাদের গাড়ির অবাঙালি ড্রাইভার শ্যামসুন্দর, দেখি সেও দুই হাত তুলে চিৎকার করছে জয় বাংলা! হঠাৎ মনে হল আমি কলকাতায় মুক্তিযোদ্ধাদের যে কমিউনে থাকি সেখানে ঢাকার অধ্যাপিকা বৌদিকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম জয়ের চূড়ান্ত খবর পাওয়ার পর রসগোল্লা খাওয়াব। অতএব কালান্তর অফিস যাওয়ার পথে গাড়ি ঘুরিয়ে আমি কমিউনে গেলাম এক হাঁড়ি রসগোল্লা নিয়ে। দরজা খুলতেই দেখি বৌদি জয় বাংলা বলে নিজেই একটা রসগোল্লা আমার মুখে গুঁজে দিলেন। বিজয়! বিজয়! ছুটে এলাম অফিসে। বিকেলে খবর এল ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ মানুষের সামনে পূর্ব রণাঙ্গন পাক বাহিনীর প্রধান লেফটন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি আত্মসমর্পণ করেছেন। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের রীতি অনুযায়ী, লেফটন্যান্ট জেনারেল অরোড়া ও লেফটন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেছেন। এরপর এই পাক সেনাপতি তাঁর ব্যাজ ও রিভলবার ভরাতীয় বাহিনী ও বাংলাদেশ মুক্তি বাহিনীর যৌথ কম্যান্ডের সেনাপতি লেফটন্যান্ট জেনারেল অরোড়ার হাতে তুলে দিয়েছেন। তখন ঢাকায় সময় বিকেল সাড়ে ৪টে, কলকাতায় বিকেল ৪টে। এই অনুষ্ঠানে ভারতীয় বাহিনীর জেনারেল নাগরা, এয়ার মার্শাল দেওয়ান, নৌবাহিনীর ভাইস অ্যাডমিরাল কৃষ্ণাণ, মেজর জেনারেল জেকব, ব্রিগেডিয়ার সন্ত সিং, ব্রিগেডিয়ার ক্রার, কর্নেল খেরা, বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর প্রতিনিধি হিসাবে গ্রুপ ক্যাপটেন এ কে খন্দকার, কাদেরিয়া গেরিলা বাহিনীর অধিনায়ক কাদের সিদ্দিকি, মুক্তিবাহীনীর ক্যাপটেন হায়দার উপস্থিত ছিলেন। পিটিআই টেলিপ্রিন্টার মেশিন অনবরত খবর দিয়ে চলছে। টেলিপ্রিন্টার মেশিন ঘিরে সহকর্মী বন্ধুদের উল্লাস। টক টক টক টকাশ…। বাংলাদেশ স্বাধীন। পূর্ব রণাঙ্গনে পাক বাহিনীর অধিনায়ক লেফটন্যান্ট জেনারেল নিয়াজির আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ। এই জয়ে এক নতুন রাষ্ট্রের জন্ম। টক টক টক টকাশ…। টেলিপ্রিন্টার মেশিনটি সমানে বেজেই চলছে। খবর আসছে। দেশবিদেশের খবর। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের প্রতিক্রিয়া। ঢাকায় পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে দিল্লিতে পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে সদস্যদের বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্যে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, এখন ঢাকা নব স্বাধীন বাংলার রাজধানী। তিনি সন্ধ্যায় ভারতের পার্লামেন্টে দেওয়া ভাষণে ভারত ও বাংলাদেশের বীর জওয়ানদের অভিনন্দন জানান তাঁদের শৌর্যের জন্য। তিনি বলেন, ভারতবর্ষ চেয়েছিল স্বাধীনতার লড়াইয়ে বাংলাদেশের জনগণকে সহায়তা করতে। বাংলাদেশ এখন স্বাধীন। তাই পশ্চিম রণাঙ্গনে যুদ্ধ চালানোর আর প্রয়োজনীয়তা নেই। রক্তক্ষরণ আর প্রাণহানির আর দরকার নেই। তিনি ১৬ ডিসেম্বর রাত ৮টা থেকে পশ্চিম রণাঙ্গনের সর্বোচ্চ অস্ত্র সংবরণের আদেশ দেন। এবং তিনি আশা করেন পাকিস্তান সরকার এই আবেদনে সাড়া দেবে। সন্ধ্যায় রেডিওতে বাংলাদেশ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের ভাষণ প্রচারিত হল।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের লড়াইয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের যে সমস্ত মানুষ ত্যাগ স্বীকার করেছেন বিশ্বের যে সমস্ত শক্তি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন তাঁদের এই নেতৃবর্গ অভিনন্দন জানালেন। টক টক টক টকাশ…টেলিপ্রিন্টার মেশিনটি খবর দিয়েই চলেছে। বিভিন্ন ব্যক্তির প্রতিক্রিয়া, লড়াইয়ের ত্যাগ আর বীরত্বের গাথা ও যুদ্ধের রণকৌশলের খবর। ভারত-পাক যুদ্ধের শুরুতেই বাংলাদেশে পাক বাহিনীর রুশ স্কোয়াড্রন বিমান এবং রুশ স্কোয়াড্রন ট্যাঙ্ক কীভাবে ধ্বংস হল তার খবর। ভারতীয় জওয়ান ও মুক্তিবাহিনী কীভাবে যৌথভাবে একাত্মভাবে লড়ে, ভারতীয় সমর বাহিনীর তিনটি বিভাগ নৌ-স্থল-বিমানবাহিনী কীভাবে যুদ্ধ করেছে ভারতীয় বাহিনী এবং মুক্তিবাহিনী কীভাবে নিজেদের মধ্যে সমন্বর রেখে চলেছে তার খবর। আমি নিজেও অবশ্য যশোর, খুলনা এবং রংপুর অঞ্চলে এই লড়াই প্রত্যক্ষভাবে দেখার সুযোগ হয়েছিল। বাংলাদেশে পাক সামরিক বাহিনীর তিনটি বিভাগীয় সদর দপ্তর, চারটি ক্যান্টনমেন্ট ও ১৯২টি আত্মরক্ষামূলক অবস্থান কীভাবে ভেঙে পড়ে তার খবর আসা শুরু হয়। মুক্তিবাহিনী গেরিলারা বাংলাদেশের ১১টি সেন্টারে লড়াই করছিলেন। ভারত-পাক যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সমন্বয় ঘটিয়ে ভারতের সৈন্যবাহিনী আটটি অঞ্চল দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ভারতীয় বাহিনী সোভিয়েত নির্মিত উভচর ট্যাঙ্ক নিয়ে প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের গতিপথের পরিবর্তন ঘটিয়ে ঢাকার উপকণ্ঠে হাজির হয়েছিল। স্থানীয় জনগণ তাদের গরুর গাড়ি থেকে নৌকা সবকিছু দিয়ে ভারতীয় বাহিনী আর মুক্তিবাহিনীকে
সাহায্য করেছিল। এটি আমরাও প্রত্যক্ষ করেছি। সেই খবরও আসা শুরু হল। বিজয়! বিজয়! চূড়ান্ত বিজয়! চট্টোগ্রাম, চাঁদপুর, খুলনা, যশোর, বকুড়া, বরিশাল, ফরিদপুর, কুমিল্লা, টাঙ্কাইল, নেত্রকোনা, সিলেট, ময়মনসিংহ, ঢাকা সর্বত্র উদ্বেলিত জনতা রাস্তায় রাস্তায় মানুষের ঢল। টেলিপ্রিন্টারে সেই খবর আসছে। ইস্, এই সময় যদি ঢাকা থাকা যেত। আমি এবার আমাদের কাগজের সম্পাদককে বললাম আমি আজকে আর লিখব না। তিনি হেঁসে বললেন এতদিন ধরে মুক্তিযুদ্ধের কথা বললে, আজ তুমি লিখবে না। তিনি বললেন, ঠিক আছে আর লিখতে হবে না। তুমি দু’দিনের মধ্যে একটি বড় লেখা তৈরি করে দেবে যুদ্ধের খুঁটিনাটি দিয়ে যেটি আমাদের বিশেষ ক্রোড়পত্রে ছাপা হবে। ইতিমধ্যেই আমার বন্ধু সাংবাদিক দীপ্তেন্দু, ঢাকার সাংবাদিক বন্ধু সর্দার দবীরউদ্দীন আহমেদ এবং হাসান আলি দপ্তরে এসে হাজির। আমি বললাম আজ আর লিখব না ছুটি, চল রাস্তায় যাই। একসঙ্গে বের হলাম আমরা। কালরাত্রির চোখ গেলে দিয়ে তখন আলো জ্বলে উঠেছে কলকাতার রাস্তায়। আবার রাস্তায় রাস্তায় মানুষ। চলমান মানুষের মিছিল। ১৩ দিন ধরে
চলেছিল কলকাতায় ব্ল্যাক আউট। এখন তা উধাও। দৈনিক সংবাদপত্রগুলিতে স্পেশাল বুলেটিন বেরিয়েছে। কলকাতা নতুন করে কল্লোলিনী হয়ে উঠেছে। পার্ক সার্কাসের কমিউনিস্ট কর্মীরা মিছিল করে বাংলাদেশের দূতাবাসে ফুল দিয়ে এসেছে। থিয়েটার
রোডে বাংলাদেশ সরকারের দপ্তরের সামনে উল্লাস। সৈয়দ আমির আলি অ্যাভেনিউয়ে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির দপ্তরের সামনে মিছিল এসেছে অভিনন্দন জানাতে। লেনিন সরণীতে লেখক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী সংগ্রাম সহায়ক সমিতির দপ্তরে আনন্দ। প্রত্যেকে প্রত্যেককে অভিনন্দন জানাচ্ছেন জড়িয়ে ধরছেন, কলকাতার অলিতে গলিতে হুল্লোড় মিছিল। অনেকক্ষণ ধরে রাস্তায় ঘুরে এসব ছবি দেখলাম আমরা, দবীর বলল আনন্দে পাগল হয়ে যাব আমরা। ইতিমধ্যে প্রায় মধ্যরাত পকেটে সকলেরই কিছু পয়সা ছিল। সামনেই উইনশোর বার। মদে আমাদের আসক্তি নেই। কিন্তু সেদিন সোজা উইনশোর বারে ঢুকে আমরা সোডা হুইস্কির অর্ডার দিলাম। আনন্দে আমরা সকলেই সেদিন পাগল। না গোপনে নয়, আজ আমরা প্রকাশ্যে মদ খাব। হুইস্কির বোতল কিনে পার্কস্ট্রিট আর জগদীশ বসুর ক্রসিংয়ে পুলিশ আইল্যান্ডে বসলাম আমরা। রাস্তায় গাড়িঘোড়া তখন বন্ধ। অনেকক্ষণ গল্প করলাম আমরা। ঘরবাড়ি, স্বপ্ন আর
আনন্দ নিয়ে গল্প। হঠাৎ হাসান বলল চল এবার ভালোবাসার কথা বলি। দবীর ঠাট্টা করে বলল। ঢাকায় রেখে আসা কারও দীঘল চোখা, আর কুন্তল কেশ রাশির কথা মনে পড়ছে তাই না। আমি হেসে বললাম এখন তো “হে যুদ্ধ বিদায়” এখন তো ভালোবাসার কথা বলারই কথা। এই বিশেষ মুহূর্তে ভালোবাসার মানুষকেই তো মনে পড়বে। দীপেন্দু এবার বলল হাসানের যাই হোক এখানে একজোড়া কালো হরিণ চোখ দিলীপের মন হরণ করেছে। তবে ভাই দেখ তোমার জন্য যেন মালওয়ান আর মুসলমান ঝগড়া না লাগে। বুঝলাম দীপেন্দু আমার পেছনে লাগছে। বললাম ভাই দীপ্তেন্দু মনহরণ না বললে হৃদয় হরণও বলতে পার। তবে দেখ মনে ম, মানুষে মা, মালওয়ানে ম, মুসলমানে ম, আবার মায়েও ম। আমাদের সকলেরই তো মা বাংলা ভাষা। তবে দীপ্তেন্দু তোমার কথা অনুযায়ী এখন থেকে ভালোলাগা বা ভালোবাসার আগে মনকে বলে দিও মন দেওয়ার আগে কুষ্ঠী দেখে নিও, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, শ্রেণি বিচার করে নিও। তবে ভাই দীপ্তেন্দু কার কিঙ্কন ধ্বনি শুনে যুদ্ধের মধ্যেও কলকাতার কোন রাস্তায় তুমি হাঁট তা আমি জানি। এবার দবীরের চোখে চোখ রেখে বললাম তুই তো ভালোবাসা কাকে বলে বুঝলি না, হাসান একটু বুঝলেও বুঝতে পারে। তবে আমি যাকে ভালোবাসি আজকে এই মুহূর্তে এই আনন্দের মধ্যে মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে তার কথা বলতে পারি। সকলেই হইহই করে উঠল। তারপর বলল ঠিক আছে আগে দিলীপ বলুক তারপর আমরা। দিলীপ বলুক বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে, ভারত-সোভিয়েত মৈত্রি চুক্তির পর ভল্গা আর গঙ্গার নাম করে কোনও তরুণী ওকে আবেগে চুমু দিয়েছে কিনা। এটি সত্য কিনা। ও বলুক পদ্মা আর মেঘনার নাম করে ও কাউকে চুমু করেছে কিনা। না খেলে কেন খায়নি। এর শাস্তি কী। আমি ওদের কথায় উত্তর না দিয়ে পুলিশ আইল্যান্ডে দাঁড়িয়ে প্রায় শেষ হওয়া রাতে প্রায় চিৎকার করে বললাম, জওয়ান ছেলেরা মিছিল করে/ ভোরের সূর্যটাকে মাথায় বয়ে এগিয়ে গেছে/ দেখ বন্ধুরা সমত্ত মেয়েরা লালপেড়ে শাড়ি পরে/ মিছিলের শরিক হয়েছে। একটু থেমে বললাম, অন্যসব মুখ যখন দুর্মূল্য প্রশাধনের প্রতিযোগিতায়/কুৎসিত বিকৃতিতে চাপার চেষ্টা করে/পচা শবের দুর্গন্ধ ঢাকার জন্য/গায়ে সুগন্ধী ঢালে/তখন অপ্রতিদ্বন্দ্বী সেই মুখ/নিষ্কশিত তরবারির মতো/জেগে উঠে আমাকে জাগায়। আমার ধরন ধারণ দেখে ওরা ভেবেছিল হয়তো নেশা আমাকে ধরে ফেলেছে। দবীর বলল মদে পাঞ্চ করে অনেকে মাতাল হয় শুনেছি। কিন্তু তুই তো দেখি কবিতা পাঞ্চ করছিস। আসলে বাংলাদেশের শাহজাহান কবীরের লেখা কবিতার কয়েক ছত্র প্রথমে বলে তারপর সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার কয়েকটি ছত্র আমি বলেছিলাম। রাস্তা একপ্রকার জনশূন্য ছিল। তাই কেউ এভাবে ওভাবে দেখেছেন কিনা জানি না। আর দেখলে কী মনে করত তা নিয়ে সেদিন আমাদের কোনও পরোয়া ছিল না। বিজয়, বিজয়, বিজয় আনন্দে আমরা মাতাল হয়েছিলাম কিনা জানি না। ইতিমধ্যে কুশায়ার বুক চিরে পার্ক সার্কাসের ট্রাম ডিপো থেকে ভোরের প্রথম ট্রাম
বের হল হেড লাইট জ্বালিয়ে। নতুন দিন শুরু হল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্য এই গ্রহের নতুন একটি স্বাধীন দেশকে অভিনন্দন জানাবে। দবীর হঠাৎ ওই আইল্যান্ডের মাঝখানে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল, আমরা এখন স্বাধীন দেশের নাগরিক, আমার ভালোবাসার স্বাধীনতা। এরপর দীপ্তেন্দুর আর আমার হাত চেপে বলে উঠল তোদের দাওয়াত, আমাদের দেশে আসবি, দেখিস আমাদের মেঘনার পানি ঘোলা হইলেও মিঠা। ভালোবাসায় খামতি নেই।”