ড. কবিতা মুখোপাধ্যায়: “সাগরের সঙ্গে লড়াই করিয়া/আমরা বাঁচিয়া আছি/তাই বলে কি সাগরের সাথে/করিতে পারি আড়ি?/…” কবিতার ছন্দে লেখা লাইন দুটি আমার মাথায় হঠাৎই ক্লিক করে ডাব বিক্রেতা এক অতি সাধারণ নারীর কথায়। একমুখ হাসি নিয়ে সাধারণ ওই মেয়েটি কী সুন্দর করে বললেন, সমুদ্র তো প্রায়ই রেগে গিয়ে আমাদেরকে একেবারে সর্বহারা করে দেয়। সে রাগ তো আমাদের অত্যাচারের কারণে ঘটে, তাই সাগর আমাদের ছুঁড়ে ফেলে দিলেও আমরা কি পারি সাগরের সঙ্গে আড়ি করে দিতে?
না, সে নারী কোনও সামাজিক দ্রোহ করেননি, করেননি কোনও না পাওয়ার অভিযোগ। তার সামনে সদাই গর্জন তোলা সমুদ্র যার এপার-ওপার চোখের সামনে নেই, আছে শুধু জলরাশি, নিরবিচ্ছিন্ন ঢেউ, আর রয়েছে অপার বিস্ময়। ভাবলে অবাক লাগে কী বিশাল শক্তি নিয়ে সে সৃষ্টির কাল থেকে বিরাজমান। বক্ষে ধারণ করে রয়েছে বহু প্রাণ, বহু বিস্ময় এবং ভালোবাসা ও ক্রোধ। যতবারই সমুদ্রের কাছে যাই মনে মনে নতজানু হই। ওই বিশাল জলরাশির অসীম শক্তিকে দেখে। মনে হয় সারাদিন, সারারাত্রি কেউ দেখুক বা না দেখুক প্রতিনিয়ত সৃষ্টি করে চলেছে ঢেউ-কখনও সে ঢেউ শান্ত, কখনও বা উত্তাল। মনে প্রশ্ন জাগে যদি এই ঢেউ সৃষ্টির কাজ সাগর বন্ধ করে দেয় তবে কী ঘটবে? সৃষ্টি ধ্বংস হয়ে যাবে? ওর গভীরে বাস করা প্রাণগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাবে? বিস্মিত হই, এত বিশাল ক্ষমতা নিয়ে কী করে আপাত শান্তভাবে বিশ্ব চরাচরের সেবা করে যাচ্ছে? চোখ বুজে ভাবতে চেষ্টা করি সেই আদিম রহস্যে আবরিত প্রাণ সৃষ্টিকারী গ্রহটিকে, ভাবতে চেষ্টা করি সেই সময়ে এই বিশাল জলরাশি অস্তিত্বও কেমন রূপে ছিল সেটা অনুভব করতে।
হ্যাঁ, বলছিলাম তাজপুরের সমুদ্রের কথা, সমুদ্রের ধারে সুন্দর কংক্রিটের রাস্তা যেটা চলে গেছে মন্দারমণির দিকে। পরিবেশটা বেশ শান্ত ও সুন্দর। সমুদ্রের কাছেই রয়েছে গ্রাম, রয়েছে বিপর্যয়ের সময়ের আশ্রয়স্থল। ওখানেই রয়েছে কিছু মানুষের রঙিন ছাতার তলায় ছোট ছোট দোকান, যে মহিলাটি ডাব বিক্রি করছিলেন, তাঁর সঙ্গে সাহায্যের জন্য দাঁড়িয়েছিল স্কুল পড়ুয়া ছেলে। বেশ সুন্দর কথা বলে। ওর সবদিকেই বেশ নজর রয়েছে। আমরা সমুদ্রের দিকে এগোতে যেতেই ছেলেটি দু হাত তুলে মানা করে। ওদিকে যেও না। কেন রে? ওখানে পা পিছলে যাচ্ছে। আজ সকালেই একটা মেয়ে পড়ে গিয়ে আঘাত পেয়েছে। আবার চা পান করতে চাইলে গ্রামের কোনও মানুষকে চা বানাতে বলছে। বেশ চৌকস ছেলেটি শীত-গ্রীস্ম-বর্ষা, নিম্নচাপ, ঝড় সব পরিবেশে দেখা সমুদ্র সম্বন্ধে ওর জ্ঞান যথেষ্টই প্রসারিত। কথাটা ও বুঝল কিনা জানি না, ছেলেটিকে বললাম, লেখাপড়া শিখছিস, প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা লিখে রাখ, কাজে লাগবে। জানি এর অর্থ ওর কাছে পরিস্কার নয়। মনে আক্ষেপ জাগে যদি আমার বাস হত সাগরপাড়ে।
তাজপুরের সমুদ্রের নির্জনতা উপভোগ করার জন্য গড়ে উঠেছে অনেক হোম স্টে, হলি হোম, তবে এখনও তেমন জমে ওঠেনি। জমে উঠলে সমুদ্র হারাবে তার নির্জনতা। সবার জন্য ডাবের অর্ডার দিয়েই গল্প জমেছিল ডাব বিক্রেতা মহিলা ও তাঁর ওই ছোট ছেলের সঙ্গে। পুজোর আগেই অশান্ত প্রকৃতির লীলায় সমুদ্রের জল পার ভেঙে প্রবেশ করলেও এরা সমুদ্রের সঙ্গে এমনই সখ্যতার বন্ধনে আবদ্ধ যে সমুদ্র সব কেড়ে নিলেও ওরা কিন্তু সমুদ্রকে ভালোবাসে, ওর আঘাতই যেন ওদের জীবন ধারণের পাথেয়। তাই তো অনায়াসেই বলতে পারে, সাগর আঘাত করলেও আমরা কি তার সঙ্গে আড়ি করে থাকতে পারি? আমাদের নিঃশ্বাসে প্রঃশ্বাসে যে সমুদ্রের লোনা জলের সুবাস-এছাড়া আমরা বাঁচব না।