বিদিশা বসু, সাংবাদিক: ‘হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা’-এ বিশ্বাসে কখনও ব্যাঘাত ঘটেনি। ঈশ্বরকে উপলব্ধির যাত্রাপথে সঙ্গী হয়েছিল অজস্র গান। তাঁর সুর, ছন্দ ও লয়ের অপূর্ব সংমিশ্রণে বারে বারে সম্মোহিত হয়েছে ভারত-ভূমি। তিনি দিলীপ কুমার রায়। নাট্যকার, সঙ্গীত স্রষ্টা, বিশিষ্ট কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পুত্র। এবার ১২৫তম জন্মবার্ষিকী পালিত হচ্ছে দিলীপ কুমার রায়ের।
২২ জানুয়ারি, ১৮৯৭ সাল। নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে জন্ম হয়েছিল বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ দিলীপকুমার রায়ের। ছোটবেলায় হারিয়েছিলেন মাকে। এরপর বাবা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের স্নেহচ্ছায়ায় বড় হতে থাকেন তিনি। কিন্তু, সেই স্নেহস্পর্শও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। মাত্র ১৬ বছর বয়সে বাবাকে হারান দিলীপকুমার রায়। এরপর শুরু হয় জীবনযুদ্ধ। ১৯১৮ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অঙ্কে অনার্স সহ বি.এ পাশ করেন। ভর্তি হন ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে অঙ্কে ট্রাইপসের প্রথম ভাগ পাশ করেন।
খুব ছোটবেলাতেই বাবা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কাছে সঙ্গীতে হাতেখড়ি দিলীপকুমার রায়ের। সঙ্গীত শিক্ষার অনুপ্রেরণা তাঁর বাবাই। পরে সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার, রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামীর কাছে তালিম নেন গানের। লন্ডনে থাকাকালে তিনি প্রেমে পড়েন পাশ্চাত্য সঙ্গীতের। শিখলেন পিয়ানো বাদন। পশ্চিমী সঙ্গীতের প্রথম ভাগ পাশ করেন। এরপর জার্মান ও ইতালীয় সঙ্গীত শেখার জন্য তিনি লন্ডন থেকে বার্লিন যান। সেখান থেকে ১৯২২ সালে ভারতে ফিরে আসেন। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিখতে শুরু করেন ওস্তাদ আবদুল করিম খাঁ, ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ, পন্ডিত ভাতখন্ডে প্রমুখের কাছে।
বিদেশ থেকে ফেরার পথে ভারতীয় সঙ্গীতের ঐতিহ্য ও পরম্পরা আবিষ্কারের ঝোঁক আসে তাঁর মাথায়। পাশ্চাত্য গান যা শিখেছিলেন তা মিশ্রিত করেন নিজের সৃষ্টিতে। সুরের নেশায় ঘুরেছিলেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। সংগ্রহ করেছিলেন লোকসঙ্গীতের অপার ভাণ্ডার। শুধু তাই নয়, বাঈজি কুঠিতেও গিয়েছিলেন সঙ্গীতের মূর্চ্ছনা উপলব্ধি করতে। নিজে বলতেন, ‘আমি যা অনুভব করি, তাইই গাই।’ আর তাঁর অনুভবেই জন্ম নিয়েছিল ‘যদি দিয়েছ বঁধুয়া’, ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’, ‘জীবনে মরণে এসো’, ‘ওরা জানে না তাই মানে না’ গানগুলি।
সঙ্গীতে একটা নিজস্ব ঘরানা তৈরি করেছিলেন দিলীপকুমার রায়। অনেক সঙ্গীতজ্ঞ সেটিকে ‘দৈলিপী ঢং’ বলেও আখ্যা দিয়েছিলেন। শুধু নিজের গান নয়। দিলীপকুমার গাইতেন বাবা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ সেন, কাজী নজরুল ইসলাম, হিমাংশুকুমার দত্তের গানও। বাংলা আধুনিক গানের অন্যতম পথিকৃৎ বলা যেতে পারে তাঁকে।
১৯২৮ সালে ঋষি অরবিন্দের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে তিনি পন্ডিচেরীর অরবিন্দ আশ্রমে আশ্রয় নেন। নিজের বসতবাড়ি সহ সমস্ত অর্থদান করেন সেই আশ্রমেই। ১৯৫০ সালের ৫ ডিসেম্বর ঋষি অরবিন্দের প্রয়াণের পরেই সম্পর্ক ত্যাগ করেন আশ্রমের সঙ্গে। তবে ত্যাগ করতে পারেননি আত্মার উত্তরাধিকার, সঙ্গীত। ঋষি অরবিন্দও বুঝতে পেরেছিলেন গানের সঙ্গে দিলীপের সখ্যতার বিষয়টি। তাই প্রিয় শিষ্যকে পরামর্শ দিয়েছিলেন সঙ্গীত সাধনার মাধ্যমেই ঈশ্বরকে খুঁজে পাওয়ার। লিখেছিলেন বেশ কয়েকটি সঙ্গীতবিষয়ক বইও। সেগুলি হল, সুরবিহার, হাসির গানের স্বরলিপি, গীতমঞ্জরী, দ্বিজেন্দ্রগীতি ইত্যাদি।
সঙ্গীত ছাড়া অন্যান্য বিষয়েও তিনি অনেক বই লিখেছিলেন। তাঁর লেখা বইয়ের সংখ্যা মোট আশি। এরমধ্যে কতগুলি উল্লেখযোগ্য বই হল, উপন্যাস মনের পরশ (১৯২৬), দুধারা (১৯২৭), দোলা (২ খন্ড, ১৯৩৫), তরঙ্গ রোধিবে কে, বহুবলভ, দ্বিচারিণী; নাটক আপদ ও জলাতঙ্ক (১৯২৬), সাদাকালো (১৯৪৪), শ্রীচৈতন্য (১৯৪৮), ভিখারিণী রাজকন্যা (১৯৫২); প্রবন্ধ শ্রীঅরবিন্দ ও ধর্মবিজ্ঞান, ছান্দসিকী, কবিঋষি গুণীশিল্পী (অরবিন্দ, রবীন্দ্রনাথ, অতুলপ্রসাদ ও শরৎচন্দ্র সম্পর্কে আলোচনা, ১৯৭৮); ভ্রমণকাহিনী ভ্রাম্যমানের দিনপঞ্জিকা (১৯২৬), ইন্দ্রধনু; স্মৃতিচারণ উদাসী দ্বিজেন্দ্রলাল, আমার বন্ধু সুভাষ, তীর্থঙ্কর, শ্রীঅরবিন্দ প্রসঙ্গ (১৯৪২), Among the Great (১৯৪০) ইত্যাদি। তিনি Eyes of Light (১৯৪৫) নামে ইংরেজি কাব্যও রচনা করেন।
দেশনায়ক সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে দিলীপকুমার রায়ের সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বের। তাঁদের বন্ধুত্ব ছিল অটুট। আমার বন্ধু সুভাষ বইটিতে সেই সম্পর্কের কিছুটা আভাস পাওয়া যায়। শেষ জীবনে পুনেয় চলে গিয়েছিলেন এই সাধক-শিল্পী। সেখানে গড়ে তুলেছিলেন হরেকৃষ্ণ মন্দির। সেখানেই সমাধিস্থ আছে তাঁর দেহ। সেই সমাধি বেদিতে লেখা তাঁর আত্মপরিচয়। লিখেছিলেন- “প্রেম আমার সাধন জানি,/ আমার জীবন মানি/ বন্ধনে মণিমুক্তোতারা প্রেম/ বিরহে প্রেম উদ্দীপন, মিলনে প্রেম উন্মাদন।”
বাংলা এমন একজন সুরকার, গীতিকার, কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকার, অনুবাদক, সুর সংগ্রাহককে মনে রাখেনি। আত্মবিস্মৃত বাঙালি তাঁকে মনে রাখেনি, চিনতে পারেনি আজও। তাঁর মতো সঙ্গীতজ্ঞের সঠিক মূল্যায়ন হয়ত করতে পারিনি আমরা। বাঙালি হয়ত ভুলে গিয়েছে, এই বাংলায় এমন একজন মানুষ ছিলেন।