যীশু চৌধুরী, বিশিষ্ট সাংবাদিক: শাঁওলি মিত্র, শম্ভু মিত্র এবং তৃপ্তি মিত্রের একমাত্র সন্তান। শুধু এই পরিচয়ই সব নয়। তিনি নিজেও আজীবন স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল ছিলেন। এমনিতে নাটকের পরিবেশের মধ্যেই তাঁর জন্ম এবং বড় হয়ে ওঠা। ফলে নাটক তো তাঁর রক্তেই মিশে ছিল। কিন্তু, অসুস্থতাও ছিল বেশ কিছুদিন ধরে। ক্রমে নিজের মনের অপরিসীম জোরে তিনি সব অসুস্থতা কাটিয়ে উঠেছিলেন। তাই পরবর্তীকালে মঞ্চ মহিমান্বিত করার ক্ষেত্রে নিজের মতো করেই অবদান রেখেছিলেন। তবে সবটাই যে তাঁর বাবা এবং মায়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে করেছেন এমনটা নয়।
ভারতের অন্য ক্ষেত্রেও তাঁর সৃজনশীল দৃষ্টি ছিল অপরিসীম। বাঙালি প্রায় জানতই না এমন একটি ব্যাপারকে তিনি হাজির করেছিলেন। প্রথম শ্রেণির একটি বাংলা দৈনিক পত্রিকায় তিনি তিজ্জনবাঈকে নিয়ে লিখেছিলেন। মধ্যপ্রদেশের এই মহান নাটকীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন অতি গরিব পরিবারের গৃহবধূ। কিন্তু, স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির দ্বারা পরিত্যক্ত হয়ে অসহায়া তিজ্জনবাঈ গ্রামে গ্রামে ঘুরে গান শোনাতেন এবং নিজের খাবার জোগাড় করতেন। ফলে গ্রামের পর গ্রামে তাঁর পাণ্ডয়ানি গান বহুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। একটি মাত্র বাদ্যযন্ত্র নিয়ে কুরু পাণ্ডবের কাহিনি গানের সুরে তিনি শোনাতেন। সেই বাদ্যযন্ত্রটি কখনও হয়ে উঠত তীর ধনুক, কখনও বা গদা, কখনও বজ্রের মতো। একাই তিনি বহু চরিত্রে অভিনয় করতেন। খেয়াল করে দেখলে আমরা বুঝতে পারব শাঁওলি মিত্রের নাথবতী অনাথবৎ এই তিজ্জনবাঈ-এরই পরোক্ষ প্রভাবে লিখিত ও অভিনীত হয়েছে। তিনি একাই মঞ্চে ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করে দেখাতেন।
চিরকালই প্রতিবাদী ভূমিকা রেখে গেছেন শাঁওলি মিত্র। ডাকঘর নাটকে বাবা, শম্ভু মিত্রের পরিচালনায় অমল চরিত্রে অভিনয় করতেন। সেই অমলকে আমরা এখনও ভুলিনি। আগামীদিনেও মনে রাখারই কথা। তেমনই আবার নাথবতী অনাথবৎ-এ তাঁর বহু চরিত্রের একক অভিনয় অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। যাঁরা দেখেছেন তাঁরা কখনও ভুলতে পারবেন না। সেই অভিনয়তেও প্রতিবাদের বীজ ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা তিনি করেছেন। তাঁর নিঃশব্দ মৃত্যু শম্ভু মিত্রের মতোই। শম্ভু মিত্রও নিঃশব্দে থাকতে চেয়েছিলেন এবং মৃত্যুর পর নীরবে চলে যেতে চেয়েছিলেন। সেদিনও সিরিটি শ্মশানেই কয়েকজন মাত্র অনুগামীর উপস্থিতিতে তাঁকে দাহ করা হয়েছিল। শাঁওলি মিত্র বাবার সেই প্রতি়জ্ঞাই পালন করে গেলেন। অর্থাৎ মৃত্যুর মধ্যে দিয়েও তিনি পিতৃযোগ্য পালন করলেন, এমনটা বলা যায়।