উত্তরপ্রদেশের ফৈজাবাদ জেলার অযোধ্যা শহরে রামকোট পর্বতের উপর নির্মিত হয়েছিল একটি প্রাচীন মসজিদ। সালটা ১৫২৮। প্রথম মোঘল সম্রাট বাবরের নির্দেশে তাঁর সেনাপতি মীর বাকি গড়ে তোলেন একটি মসজিদ। পরে যার নামকরণ সম্রাট বাবরের নামে করা হয়। ‘বাবরি মসজিদ’। দিল্লির সুলতানি এবং তার উত্তরাধিকারী মুঘল সাম্রাজ্যের শাসকরা শিল্প এবং স্থাপত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁদের নির্মিত অনেক সমাধি, মসজিদ ও মাদ্রাসা সূক্ষ্ম নির্মাণকৌশলের অমূল্য নিদর্শন বহন করে চলেছে আজও। বাবরি মসজিদ জানপুরের সুলতানি স্থাপত্যের পরিচয় বহন করে। ঐতিহাসিক মসজিদটি তার স্থাপত্য ও স্বতন্ত্র গঠনশৈলীর জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
বিতর্কিত এই স্থানের ঐতিহাসিক ঘটনাবলি ফিরে দেখা যাক।
১৫২৮: সম্রাট বাবরের আদেশে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়। যে কারণে জনমুখে মসজিদটির নাম হয়ে যায় বাবরি মসজিদ৷ হিন্দুত্ববাদীদের মতে, হিন্দুধর্মের অন্যতম আরাধ্য দেবতা রাম জন্মগ্রহণ করেছিলেন এই স্থানেই। সেখানে একটি মন্দির ভেঙে মসজিদটি তৈরি করা হয়েছিল।
১৮৫২: ফৈজাবাদ জেলার ১৯০৫ সালের গ্যাজেটিয়ার অনুযায়ী, ১৮৫২ সাল পর্যন্ত হিন্দু এবং মুসলমান, দুই সম্প্রদায়ই সংশ্লিষ্ট সৌধটিতে প্রার্থনা ও পূজার্চ্চনা করেছে৷
১৮৫৩: এই ধর্মীয় স্থানকে কেন্দ্র করে প্রথমবার সহিংসতার ঘটনা ঘটে বলে জানা যায়। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রশাসন দুই ধর্মের উপাসনার জায়গায় দেওয়াল তুলে আলাদা করার চেষ্টা করে। প্রাচীরের ভেতরের চত্বর মুসলিমদের জন্য এবং বাইরের চত্বর হিন্দুদের ব্যবহারের জন্য নির্ধারিত হয়।
১৯৪৯: ২৩ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদের অভ্যন্তরে রাম-সীতার মূর্তি স্থাপন করা হয়৷ বেআইনিভাবে ওই মূর্তিগুলি স্থাপনের অভিযোগ ওঠে হিন্দুত্ববাদীদের একাংশের বিরুদ্ধে। মুসলিমরা প্রতিবাদ জানায় এবং দুই পক্ষই দেওয়ানি মামলা করে। দেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী গোবিন্দ বল্লভ পন্থকে চিঠি লিখে হিন্দু দেব-দেবীদের মূর্তি অপসারণ করার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, “ওখানে একটি বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করা হচ্ছে৷”
১৯৮৪: বিশ্ব হিন্দু পরিষদ মসজিদের তালা খুলে দেওয়ার দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন শুরু করে৷ ১৯৮৫ সালে রাজীব গান্ধীর সরকার ঠিক সেই নির্দেশই দেন৷ VHP-এর নেতৃত্বে রামের জন্মস্থান উদ্ধার এবং তাঁর সম্মানে মন্দির প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি কমিটি গঠন করা হয়।
১৯৮৬: জেলার বিচারক আদেশ দেন যেন বিতর্কিত মসজিদের দরজা উন্মুক্ত করে দিয়ে হিন্দুদের সেখানে উপাসনার সুযোগ দেওয়া হয়। মুসলিমরা এর প্রতিবাদে বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটি গঠন করে।
১৯৮৯: নভেম্বরে সাধারণ নির্বাচনের আগে VHP বিতর্কিত স্থানটিতে মন্দিরের শিলান্যাস-এর অনুমতি পায়৷ BJP নেতা লালকৃষ্ণ আডবানি ১০ হাজার কিলোমিটার দূরত্বের ‘রাম রথযাত্রা’ শুরু করেন৷
১৯৯০: VHP-এর কর্মীরা মসজিদের আংশিক ক্ষতিসাধন করে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখর আলোচনার মাধমে বিতর্ক সমাধানের চেষ্টা করলেও তা বিফল হয়।
১৯৯১: উত্তর প্রদেশে ক্ষমতায় আসে বিজেপি।
১৯৯২: ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর এলকে আডবানি, মুরলি মনোহর যোশি, বিনয় কাটিয়া সহ অন্যান্য নেতারা মসজিদ প্রাঙ্গনে পৌঁছন৷ VHP, BJP, শিবসেনা কর্মী ও সমর্থকরা বাবরি মসজিদে হামলা চালায়৷ দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে হিংসা৷ সংঘর্ষে ২ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যায়।
১৯৯৮: প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ীর অধীনে জোট সরকার গঠন করে BJP।
২০০১: মসজিদ ধ্বংসের বার্ষিকীতে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। ওই স্থানে ফের মন্দির তৈরির দাবি তোলে VHP।
২০০২: জানুয়ারিতে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী দু’পক্ষের সমঝোতার জন্য বিশেষ সেল গঠন করেন৷ বলিউড অভিনেতা শত্রুঘ্ন সিনহাকে হিন্দু ও মুসলমানদের নেতাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়৷
২০০২: উত্তর প্রদেশের নির্বাচনের তফসিলে মন্দির তৈরির বিষয়টি বাদ দেয় বিজেপি। ফেব্রুয়ারিতে গুজরাতের গোধরায় অযোধ্যার করসেবক বোঝাই ট্রেনে হামলার ঘটনায় ৫৮ জনের মৃত্যু হয়। মার্চে ট্রেন হামলার ঘটনার জের ধরে গুজরাতে হওয়া হিংসায় প্রায় ২ হাজার মানুষের মৃত্যু হয় বলে জানা যায়।
২০০২: এপ্রিলে ধর্মীয়ভাবে পবিত্র হিসেবে বিবেচিত জায়গাটির মালিকানার দাবিদার কারা, তা নির্ধারণ করতে তিনজন হাইকোর্ট বিচারক শুনানি শুরু করেন।
২০০৩: ওই স্থানে রাম মন্দিরের কোনও নিদর্শন আছে কিনা, তা যাচাই করতে আদালতের নির্দেশে জানুয়ারিতে নৃতত্ববিদরা জরিপ শুরু করেন।
২০০৩: অগাস্ট মাসে জরিপে প্রকাশিত হয় যে মসজিদের নীচে মন্দিরের চিহ্ন রয়েছে, কিন্তু মুসলিমরা এই দাবির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
২০০৩: সেপ্টেম্বরে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পেছনে উস্কানি দেয়ায় ৭ জন হিন্দু নেতাকে বিচারের আওতায় আনা উচিত বলে রুল জারি করে একটি আদালত। তবে সেসময়কার উপ-প্রধানমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদবানি, যিনি ১৯৯২ সালে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ আনা হয়নি।
২০০৪: উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতায় ফেরে কংগ্রেস। উত্তরপ্রদেশের আদালত রায় দেয়, এই মামলায় আদবানির নামও রাখতে হবে।
২০০৫: জুলাই মাসে অযোধ্যায় জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে। বিস্ফোরক ভর্তি একটি জিপ দিয়ে বিতর্কিত স্থানে হামলা চালানো হয়। তবে নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের গুলিতে নিহত হয় ৬ জন। যাদের মধ্যে পাঁচজনই জঙ্গি বলে দাবি করে নিরাপত্তা রক্ষীরা।
২০০৯: মসজিদ ধ্বংস হওয়া সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে থাকা লিবারহান কমিশন তদন্ত শুরু করার ১৭ বছর পর জুন মাসে তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়।
২০০৯: নভেম্বরে প্রকাশিত লিবারহান কমিশনের প্রতিবেদনে মসজিদ ধ্বংসের পেছনে BJP-এর শীর্ষ রাজনীতিবিদদের ভূমিকার বিষয়টি উল্লেখ করা হয় এবং এনিয়ে সংসদে হট্টগোল হয়।
২০১০: সেপ্টেম্বরে এলাহাবাদ হাইকোর্ট রায় দেয় বিতর্কিত স্থানটির নিয়ন্ত্রণ ভাগাভাগি করে দেওয়া উচিত। কোর্টের রায় অনুযায়ী, এক-তৃতীয়াংশের নিয়ন্ত্রণ মুসলিমদের, এক-তৃতীয়াংশ হিন্দুদের এবং বাকি অংশ ‘নির্মোহী আখারা’ গোষ্ঠীর কাছে দেওয়া উচিত। যেই অংশটি বিতর্কের কেন্দ্র, যেখানে মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছিল, তার নিয়ন্ত্রণ দেওয়া হয় হিন্দুদের কাছে।
২০১১ মে: ২০১০ সালের রায়ের বিরুদ্ধে হিন্দু ও মুসলিম দুই পক্ষই আপিল করায় হাইকোর্টের পূর্ববর্তী রায় বাতিল করে সুপ্রিম কোর্ট।
২০১৯: নভেম্বরে বিতর্কিত স্থানে মন্দির তৈরির পক্ষেই চূড়ান্ত রায় দেয় সুপ্রিম কোর্ট।
২০২০: ৫ ফেব্রুয়ারি, রামমন্দির নির্মাণে ট্রাস্ট গঠনের কথা ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
২০২০: ৫ আগস্ট রামমন্দির নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।