যীশু চৌধুরী(বিশিষ্ট সাংবাদিক): আফগানিস্তানের গত কয়েক সপ্তাহের ঘটনাবলী অনেক বিশেষজ্ঞকেও অবাক করে দিয়েছে। এপ্রিল মাসের প্রথম দিক থেকে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে তালিবানের লড়াই চলছিল বেশ কয়েকটি এলাকা জুড়ে। কিন্তু ১৩ অগস্ট দেখা গেল ১১টি প্রদেশের রাজধানী শহরগুলি তালিবানরা দখল করে নিয়েছে মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে। তার দুদিন পরেই তারা দখল করল কাবুল শহর। আমেরিকাও তাদের সৈন্য প্রত্যাহারের কথা জানালো ওই সময়ই। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তিনটি বিষয় আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। সেগুলি হল ১. আমেরিকা আর পৃথিবীর এক নম্বর শক্তি থাকছে না। ২. পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ পুরোপুরি অনিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে। এবং ৩. চিনের রাষ্ট্রনীতির আদর্শ পুরোপুরি জলাঞ্জলিতে চলে গেল।
"We will not forgive. We'll not forget. We will hunt you down and make you pay," US President Joe Biden to Kabul bombers pic.twitter.com/H3BFTLzZ77
— ANI (@ANI) August 26, 2021
আমেরিকা যে আর সবার সেরা শক্তি থাকবে না সেটা বোঝা যাচ্ছে বেশ কিছু দিন ধরেই। ইরাকের সঙ্গে তাদের যুদ্ধের সময়ই সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘নিউজ উইক’ একটি প্রচ্ছদ কাহিনি করেছিল ‘হু উইল ফাইট ফর আমেরিকা’ এই শিরোনামে। ইরাকের সঙ্গে যুদ্ধে দেখা গিয়েছিল আমেরিকার অধিকাংশ সৈনিকই আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহারই ঠিক মতো জানে না। তাছাড়া তাদের রণকৌশল নীতিও যথেষ্ট দক্ষ নয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়ই জেনারেল গিয়াপ আমেরিকান বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে ছেড়ে দিয়েছিলেন। সে সময় তারা ভিয়েতনাম ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হয়। এরপরে সবক্ষেত্রেই দেখা গেছে তাদের বীরত্ব ও শৌর্য বলতে কিছুই নেই। আফগানিস্তানেও সেটা প্রমাণ হল।
পাকিস্তানের সঙ্গে আমেরিকার গলাগলি বহুদিনের। চিনের সঙ্গেও পাকিস্তানের বন্ধুত্ব রয়েছে। তাহলে এই দুটি দেশের অবস্থান কি একই ? রাশিয়া নিশ্চয়ই সে ব্যাপারে সচেতন। যে তালিবানরা পাকিস্তানে রীতিমতো আশ্রয় এবং মদত পেয়েছে তারাই একটি দেশের ক্ষমতায় এল। এবার নিশ্চয়ই তাদের নজর পড়বে খোদ পাকিস্তানের দিকেই। সেক্ষেত্রে পাকিস্তানকে বাঁচানোর মতো কেউ নেই।
তালিবানরা ২০ বছর আগে যেমন ছিল, এখনও তেমনই আছে কি না সে প্রশ্ন অবান্তর। কারণ তারা ক্ষমতা দখল করেছে বিভিন্ন এলাকায় ধ্বংসের কাজ চালিয়ে। ফলে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার তারা পছন্দ করে না, এটা একরকম ঠিকই হয়ে গেছে। আধুনিক আফগানিস্তানের বিশিষ্ট লেখক খালেদ হোসেইন ‘দ কাইট রানার’ উপন্যাসে রুশ অধিকারের কথাই বর্ণনা করেছেন। তাঁর পরের উপন্যাস ‘এ থাউসেন্ড স্প্লেনডিড সানস’ -এ তিনি মূলত একটি ক্ষতবিক্ষত দেশের বর্ণনা করেছেন। সেই অস্থির অবস্থার মধ্যে কেমন ছিল পরিবার জীবন এবং পরস্পরের মধ্যে সম্পর্ক, তা গভীরে গিয়ে বর্ণনা করেছেন। সেখানে এক জায়গায় বলেছেন আফগান জীবনে সব দোষ এসে পড়ে মেয়েদের উপরই, যেন কম্পাসের কাঁটা। কাবুল দখল হয়ে যাওয়ার পরে সেখান থেকে সরে যাওয়া অনেক বিশিষ্ট নারীই ওই একই কথা বলেছেন। তাঁরা বলেছেন তালিবানরা যে ফের মেয়েদের গভীর অন্ধকারে পাঠিয়ে দেবে সেটা ওই কম্পাসের কাঁটার মতোই নির্দিষ্ট হয়ে আছে। এনিয়ে দ্বিধার কোনও জায়গা নেই। কারণ, যে শরিয়ত আইনের কথা বলে এইসব নির্দেশ জারি হচ্ছে তা আদৌ শরিয়তি আইন কি না, তা নিয়েও সন্দেহ আছে। ইরানেও তো শরিয়ত আইন চলে। কিন্তু সেখানে মেয়েদের এভাবে দুর্দশায় পড়তে হয় না।
তাহলে এটা পরিষ্কার তালিবান শাসনে আফগানিস্তানের কোনও উন্নতি সম্ভব নয়। সে চিন সাহায্য করলেও নয়। কারণ যার ভিতরে অগ্রগতির ইচ্ছে নেই তাকে কেউই টেনে তুলতে পারবে না। তাই আফগানিস্তানের উন্নতির জন্যে আগে দরকার তালিবানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। সেদেশের বহু মানুষ এখন এই রুখে দাঁড়ানোর পরিস্থিতি তৈরি করেছেন। ফলে আফগানিস্তান নিয়ে আমাদের পুরোপুরি হতাশ হওয়ার কিছু নেই।