Share it

নিউজ ওয়েভ ইন্ডিয়া: সম্প্রতি শেষ হল বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলন। এ ব্যাপারে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, এবছরের সম্মেলনে মোটোমোটিভাবে পৌনে চার লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগ আসার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এই সম্ভাবনা কতটুকু বাস্তব হবে তা ভবিষ্যৎ বলতে পারবে। পুরোটা বাস্তব রূপায়ণে না-ও আসতে পারে। সেটা স্বাভাবিকও বটে। একটা কথা সবসময় মনে রাখা ভালো বাণিজ্য সম্মেলন বহুজনকে নিয়ে করা হয়। তাই সরকারের সদিচ্ছা সবসময় সেখানে প্রতিফলিত হবে এমন না ঘটতেও পারে।

বিরোধিরা অবশ্য, মানে এই বাণিজ্য সম্মেলনের বিরোধিরা প্রথম থেকেই এব্যাপারে হতাশা প্রকাশ করেছেন এবং নঞ্যর্থক মন্তব্য করেছেন, সেটাও হয়ত স্বাভাবিক কারণ, বাণিজ্য সম্মেলন মানে কেবল বাণিজ্য, মুনাফা, আর্থিক ফায়দা তোলা ইত্যাদি এমনটাই মনে করে থাকেন অনেকে। কিন্তু বাণিজ্য সম্মেলনের প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে দারিদ্র দূর করা, আরও বেশি করে কাজের সুযোগ খুঁজে দেওয়া এবং সার্বিকভাবে পুরো দেশের উন্নয়ন।

রাজ্যগুলির উন্নয়ন মানেই পুরো দেশের উন্নয়ন। আমাদের দেশে মোটামোটিভাবে রাজ্যগুলিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। তার মধ্যে প্রথম শ্রেণির রাজ্যগুলি আর্থিকভাবে মোটোমোটি সফল। মাঝের শ্রেণির রাজ্যগুলি কিছুটা দুর্বল, তবে অসহায় নয়। কিন্তু একবারে কম উন্নত রাজ্যগুলি মোটোমোটিভাবে কেন্দ্রের মুখ চেয়েই থাকে। যতই ভাগ করা হোক। সব রাজ্যগুলির ক্ষেত্রেই দারিদ্র একটা বড় ব্যাপার। সে মহারাষ্ট্র হোক, গুজরাট হোক, কর্ণাটক হোক কিংবা পশ্চিমবঙ্গ হোক, দরিদ্র মানুষের সংখ্যা সর্বত্রই যথেষ্ট এবং তাদের খাওয়া, থাকা, পরা এবং শিক্ষা রীতিমতো বড় সমস্যা। তাই কেউ যদি মনে করেন বাণিজ্য সম্মেলন মানেই মুনাফা কিংবা ব্যবসার উন্নতি তবে সেটা ভুল হবে। দরিদ্র মানুষের মুখে খাবার যুগিয়ে দেওয়া তাদের মাথার উপর ছাদ তৈরি করে দেওয়া কিংবা তাদের লেখাপড়া শেখানো এসবও বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিতে পারে। স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের দেশে জনকল্যাণমূলক অর্থনীতি চালু করা হয়েছিল, সেকারণেই তৈরি হয়েছিল পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাগুলি। এই পরিকল্পনার পিছনে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সপ্তবার্ষিকী পরিকল্পনা কাজ করেছে। যদিও স্বাধীনতার আগেই কংগ্রেস অধিবেশনে সেসময়কার সভাপতি (তখন বলা হত রাষ্ট্রপতি) সুভাষচন্দ্র বসু পরিকল্পনা কমিশন তৈরির প্রস্তাব দেন। সেই কমিশনের প্রধান হিসেবে তিনি নিজেই পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর নাম প্রস্তাব করেছিলেন। দলের অধিবেশনে তা গৃহীতও হয়েছিল। স্বাধীনতার পরে পণ্ডিত নেহরু পরিকল্পনা কমিশন বজায় রেখেছিলেন এবং পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ভাবনাকে রূপায়ণ করেছিলেন।

এর মূল উদ্দেশ্যই ছিল দারিদ্র দূর করা। প্রতিটি খসড়া পরিকল্পনাই তৈরি হত দরিদ্র এবং মধ্যবিত্তদের সুযোগ সুবিধের দিকে তাকিয়ে। তাতে দেশের উন্নয়ন যতটুকু হওয়ার তা হয়েছে। পরে ডক্টর মনমোহন সিং অর্থমন্ত্রী থাকার সময় খোলাবাজার নীতিটি গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর সেই গৃহীত নীতির ফলে দেশকে অনেকটাই সুসংহত করা গিয়েছিল বলে মনে করা হয়। কিন্তু সেক্ষেত্রেও জনকল্যাণ মূলক অর্থনীতি পুরোপুরি ত্যাগ করা হয়নি। পরবর্তীকালে নতুন সরকার আসার ফলে জনকল্যাণমূলক নীতিকে পরিত্যাগ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সেই জনকল্যাণমূলক নীতিগুলিকে ‘রেউড়ি’ সংস্কৃতি বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু ভেবে দেখলে এই রেউড়ি-ই বাঁচিয়ে রেখেছে দেশের বিরাট গরিব সমাজকে। যদিও পরবর্তিকালে কম মূল্যে রান্নার গ্যাস, বিনামূল্যে রেশন ইত্যাদি সেই গরিবদেই আরও বড়ভাবে সাহায্য করেছে। (এভাবে রেশন দেওয়ার প্রথম পরিকল্পনা রূপায়ণ করেছিলেন তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা) কম দামে রান্নার গ্যাস দেওয়ার পিছনে অবশ্য দূষণ মুক্তির কথা ভাবা হয়েছে। কারণ গরিবরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কুড়িয়ে আনা কাঠকুটরো জ্বেলে রান্না করেন। কেউ কেউ নিজের হাতের বানানো ঘুঁটে দিয়েও রান্নার কাজ সেরে নেন। এক্ষেত্রে যে ধোঁয়ার সৃষ্টি হয় তা প্রকৃতির উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। সেকথা ভেবেই রান্নার গ্যাসের ব্যবহার আরও বাড়ানোর কথা। প্রতি ঘরেই যদি এই সহায়তা পৌঁছে দেওয়া যেত তাহলে দূষণ অনেক কমে যেত।

ফলে যে কেনও একটা বাণিজ্য সম্মেলন মানেই তার পিছনে বিরাট সংখ্যক দরিদ্রের ছায়া কাজ করার কথা। সেটা সবসময় ভাবা হয় না। যেখানে ভাবা হবে সেখানেই বাণিজ্য সম্মেলন সফল, তা সে যত বড় বা ছোটো অঙ্কেরই হোক। কোনও কোনও রাজ্য আমাদের দেশের উন্নয়নের কথা ভাবলেও গরিবের কথা ভাবে না। তাতে দেখা গেছে গত কয়েক বছরে মাত্র কয়েকটি পরিবার আরও ফুলে ফেঁপে উঠেছে। অন্যদিকে গরিব আরও গরিব হয়েছে। এইক্ষেত্রে ভারসাম্য ঠিকমতো রাখাটাই প্রকৃত আর্থিক উন্নয়ন। সেটা যিনি পরিষ্কার ভাবতে পারবেন তিনি যেকোনও বাণিজ্য সম্মেলনের গুরুত্ব বুঝতে পারবেন। প্রত্যেকক্ষেত্রেই বিনিয়োগের সঙ্গে সঙ্গে কর্মসংস্থানের সংখ্যাও মোটোমোটিভাবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। এটা স্বাভাবিক। কারণ বিনিয়োগের ফলে একজন ব্যবসায়ী কতটা মুনাফা আদায় করলেন তার চেয়ে বড় কথা আরও কতজন লোক কাজ পেলেন এবং উপার্জনের সন্ধান পেলেন। এখনও পর্যন্ত গরিবদের একটা বড় অংশই ‘স্বনির্ভর’। তাদের প্রতিদিনের খাবার সপরিবারে উপার্জন করে নেওয়ার চেষ্টা করেন নিজেরাই। যেখানে তা সম্ভব হয় না সেখানে অনশন অনিবার্য। তাই অনিবার্য অনশন ঠেকাবার জন্যে দরকার হয় সরকারি সহায়তার। আমরা কে কতটা তা দিতে পারছি তা সাফল্যের মাপকাঠি হিসেবে চিহ্নিত হবে।

অনেকেই মনে রেখেছেন অবিভক্ত অন্ধ্রপ্রদেশে সবচেয়ে বেশি আর্থিক উন্নয়ন ঘটিয়েছিলেন চন্দ্রবাবু নাইডু। তিনি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সত্যিই উন্নয়নের কাজ করেছিলেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, সেবারই চন্দ্রবাবু নাইডুর দল তেলুগু দেশম পার্টি ভোটে হেরে গিয়েছিল। তার মানে বোঝা যাচ্ছে তাঁর উন্নয়নের কোনও প্রভাব নিচু তলায় গিয়ে পড়েনি। এবং সেই গরিবরাই তাঁকে ত্যাগ করেছিলেন। তাই উন্নয়নের কথা যাঁরা বলেন তাঁদের উচিত এই চূড়ান্ত খামতির দিকে নজর রাখার। এক্ষেত্রে কত টাকার বিনিয়োগ হল তা বড় কথা নয়।

যদিও আমাদের দেশে জনসংখ্যার বৃদ্ধি যে ঘটছে সেটা মাথায় রাখা দরকার। জনসংখ্যার দিক থেকে ভারতে বড় শহরগুলির মধ্যে আছে মুম্বই, দিল্লি, কলকাতা, চেন্নাই। এবার বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা ঢাকায়। শহরগুলিতে এই ভিড় যে জন্মসূত্রে নয় সেটা ঠিক। বঞ্চিত গ্রামগুলি থেকে দলে দলে মানুষ শহরে এসে ভিড় জমায় দুবেলা দু-মুঠো খাবার আশায়। এমনকি ভিখারিরাও জানেন গ্রামাঞলের চেয়ে শহরাঞ্চলে ভিক্ষা বেশি পাওয়া যাবে। তাই গ্রামের উন্নয়ন সবার আগে দরকার। একথা অনেক আগেই বলে গেছেন রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা গান্ধী, সুভাষচন্দ্র বসু, পণ্ডিত নেহরু প্রমুখ সকলেই। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, শরীরের সব রক্ত যদি মুখে এসে জমা হয় তাহলে সেটাকে স্বাস্থ্যের লক্ষণ বলে মোটেই বলা যায় না। অর্থাৎ উন্নয়ন শহর এবং গ্রাম দুজায়গাতেই হতে হবে। তাই বিশ্ববঙ্গ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্মেলন বিনিয়োগের অঙ্ক দিয়ে সফল কিনা তা বিচার করা ঠিক হবে না, দেখতে হবে এর সুফল গ্রামে গিয়েও সমান হারে পৌঁছচ্ছে কিনা। তা পৌঁছে দিতে পারলে সেটাই হবে সম্মেলনের সাফল্য। আগামী দিনগুলিতে সেই সাফল্য কতটুকু তা বোঝা যাবে।

Share it