নিউজ ওয়েভ ইন্ডিয়া: আমাদের দেশে বেশ কিছুদিন ধরেই চাণক্যের ছড়াছড়ি। রাজনীতিতে কাউকে ভালো লাগলেই তাকে ‘চাণক্য’ উপাধি দেওয়া হয়। একসময় সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চাণক্য নামে অভিহিত হতেন। পরে পি ভি নরসিমা রাও, প্রণব মুখোপাধ্যায়রাও চাণক্যের মর্যাদা পেয়েছিলেন। কিছুদিন অটলবিহারি বাজপেয়িকেও এই নামে চিহ্নিত করা হত। আমাদের সৌভাগ্য ইতিমধ্যেই আর একজন চাণক্যকে আমরা পেয়ে গেছি। তিনি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তিনি বহুদিন ধরেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে রাজনীতিতে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত।
পশ্চিমবঙ্গে গত বিধানসভা নির্বাচনে রাজনীতিতে দক্ষ এই ব্যক্তি ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন তাঁর দল ভারতীয় জনতা পার্টি ২০০-র বেশি আসন পাবে। এবং সরকার করবেন তাঁরাই। কিন্তু সেই চেতাবনি তেমন মেলেনি। যদি মিলত তাহলে এতদিনে আমরা দিলীপ ঘোষ, ডক্টর সুকান্ত মুজমদার, শুভেন্দু অধিকারী, তথাগত রায় কিংবা রাহুল সিনহাকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দেখতে পেতাম। তেমনটা হয়নি। কারণ সবাই জানেন, বিজেপি ২০০-র ধারেকাছেও পৌঁছতে পারেনি। তাই চাণক্যের ভবিষ্যৎ রাশিফল শূন্যে মিলিয়ে গেছে।
গত বুধবার ২৯ নভেম্বর কলকাতায় এসে জনসভা করে গেছেন অমিত শাহ। এবার তিনি বলেছেন, আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে এই রাজ্য থেকে তাঁর দল ৩৫টি আসন পাবে। আমাদের রাজ্যে লোকসভা আসন সংখ্যা ৪২টি। আমিত শাহ সাতটি আসন কেন বাকি রেখেছেন তা বোঝা গেল না। কারণ এই রাজ্যে তাঁদের সঙ্গে কারও কোনও জোট নেই। ফলে আসন ছাড়ার কোনও কথা ওঠে না। তাই ৩৫টি না বলে তাঁর ৪২টি আসনের কথাই বলা উচিত ছিল। কিন্তু সেটা তিনি না বলে পরিচয় দিয়েছেন কি উদারতার ? অর্থাৎ বিরোধিরাও কিছু আসন পাক। এই উদারতা আমাদের দেশে রাজনীতিতে বিরল বলা চলে। যদিও গণতন্ত্রে এই মনোভাব স্বাভাবিক। কিন্তু কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই উদারতা কি সত্যিই দেখাচ্ছেন, নাকি ৩৫-এর বেশি আসন পাবেন না এমন আশঙ্কা করছেন।
যদি বিপেজি ৩৫টি আসন পায় তাহলে ৭টি আসন বাকি রাখা ঠিক হবে না। বিভিন্ন রাজ্যে কোটা বেঁধে দিয়ে বিজেপি প্রচার চালাচ্ছে। জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের মধ্যে দিয়ে আমাদের বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার নিজেকে ‘বিশ্ব গুরু’ বানাতে চেয়েছেন। কিন্তু তা কার্যত সফল হয়নি। সে যাই হোক, আমাদের বক্তব্য ৪২টি আসন নিয়ে।
যেসব কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থীরা বিজয়ী হয়ে লোকসভায় যাবেন তাঁদের সামনে কার্যত কোন আদর্শ থাকবে তার উপর অনেকটা নির্ভর করবে নবনির্বাচিতদের গুরুত্ব। সত্যি কথা বলতে কী বিজেপি-র সামনে আর তেমন কোনও আদর্শ নেই। আর নেই বলেই তারা বিভিন্ন ধর্মীয় প্রচার চালাচ্ছেন। অর্থাৎ আমাদের দেশে করোনার পর থেকে সাধারণ মানুষের কাছে খেতে পাওয়া এবং চাকরি পাওয়ার ব্যাপারটাই বড় হয়ে উঠেছে। বিজেপি-র গত প্রায় দশ বছরের শাসনকালে কোনও দিকেই কোনও রকম উন্নতি হয়নি সেটা এখন অনেকেই বুঝতে পারছেন। সরকার এবং তাঁর চাণক্য এই সংকট উপলব্ধি করতে পারছেন না তা হতে পারে না। ক্ষমতায় বসার পর থেকে প্রত্যেকেই আমাদের দেশে ধর্মীয় নানা আচরণ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে পালন করে আসছেন। কারণ ভোট পাওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় এটাই। এই গুরুত্ব খাদ্য, পানীয়, শিক্ষা এবং বাসস্থানের পিছনে দিতে পারলে শ্রীরামচন্দ্রের পরম ভক্তরা সমৃদ্ধ হতে পারত। কিন্তু তেমন কোনও নজির তাদের সামনে এখনও নেই। শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলেছিলেন, “অন্ন চিন্তা চমৎকারা, অন্য চিন্তা পরাৎপরা”। মানে সবার আগে ভাবতে হবে ভাতের কথা, অন্য কথা তারপরে।
আমাদের কেন্দ্রীয় সরকার যতটা ধর্ম নিয়ে ভাবছেন ততটা পেটের ভাত নিয়ে ভাবছেন না। কোনও কোনও ক্ষেত্রে বিজেপি হয়তো জিততে পারে কিন্তু সারা দেশেই তারা অর্থপূর্ণভাবে নীরব থাকে গরিবকে নিশ্চয়তা দেওয়ার ব্যাপারে। গরিবরা যতদিন এই নিশ্চয়তা বা আশ্রয় না পাচ্ছেন ততদিন তাদের ভোট ব্যাঙ্ক বলে কোনও কিছু তৈরি হতে পারবে না। ভোট ব্যাঙ্ক না থাকলে উড়ো ভোট এদিক ওদিক করবে। হয়তো বা বিজেপি-কেও কিছু ভোট তাঁরা দেবেন। কিন্তু তা দিয়ে সারা দেশে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হওয়ার কথা নয়। আমাদের রাজ্যেও ৩৫টি লোকসভা আসন তারা একাই জিতে নিয়ে চলে যাবে এমনটা হওয়ার কথা নয়। তাই নানা বাস্তব অবস্থা পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, লোকসভা আসনের অর্ধেকও তাঁরা পূরণ করতে পারবেন কিনা।
কটা আসন পেতে হবে সেতো তিনি বলে দিয়ে গেছেন। এই এতগুলি আসন পাওয়ার জন্যে যে ধরনের সংগঠন এবং উদ্যোগ দরকার তার কোনওটাই নেই। বিশেষ করে সংগঠনগুলি শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি কাজ করে। কিন্তু সেখানে পৌঁছনো সবার আগে দরকার। তা আপাতত পৌঁছন সম্ভব হবে না এটা একরকম নিশ্চিত।
আমাদের দেশে চিরকাল চাণক্যরাই রাজনীতিতে লাঠি ঘুরিয়েছেন। তবে অনেক ক্ষেত্রেই সেব্যাপারে লাভই হচ্ছে। কিন্তু লাভটা কার। তা বিবেচনা করা দরকার। যদি সত্যিই ৩৫টি বা আশপাশে আসন পেয়ে যায় বিজেপি তাহলে এই রাজ্যে আগামীবার তারাই ক্ষমতায় বসবে। কিন্তু, ক্ষমতায় বসে কোন কর্মসূচি নেবে তা বিবেচনা করার দরকার আছে। এক্ষেত্রে ৩৫টি নাকি পুরো ৪২টি তা ভোটের ফল বেরোনোর পর বোঝা যাবে। তবুও বিভিন্ন রাজ্যের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বোঝার জন্যে কয়েকটি বিধানসভা নির্বাচন অনেকখানি সহায়ক হবে। কিন্তু অমিত শাহ কলকাতায় এসে ওই বিধানসভাগুলির নির্বাচন সম্পর্কে তেমন কোনও উচ্চবাচ্য করেননি। তাঁর প্রায় ২৪ মিনিটের বক্তৃতায় দেশের সার্বিক পরিস্থিত নিয়েও কোনও কথা বলেননি। কারণ, বলার কিছু নেই। আর অন্যদিকে বেকারত্ব, আর্থিক অবস্থা, শিক্ষার হার ইত্যাদি নিয়েও বড় মুখ করে বলার কিছু নেই। তাই যথারীতি রাম মন্দির ইত্যাদি বলে দায়িত্ব শেষ করেছেন। যদিও এই রাজ্যে বিজেপি-রই এক বিশিষ্ট নেতা ৩৫টি আসনের ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তাঁর ধারণা তাঁরা যদি ৫টি আসনও পান তাহলেই যথেষ্ট। আসলে সবকিছু নির্ভর করে সংগঠন শক্তির উপর। আমরা সকলেই জানি আপাতত এরাজ্যে বিজেপি-র সংগঠন শক্তি নিয়ে তেমন গৌরবজনক কোনও ভাষ্য দেওয়া যায় না। তাই ৩৫ থেকে অনেক কম আসনই ভাবতে হবে বিজেপি-কে।
উপায় নেই। এটাই ভবিতব্য।