অশোক বসু: এবারের মতো ভাঙল মিলনমেলা। বইয়ের মিলনমেলা। কলকাতা বইমেলা প্রায় পাঁচ দশক পূর্ণ করতে চলল। ১৯৭৬ সালে খান তিরিশেক স্টল দিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল বইমেলার। রবীন্দ্র সদনের উল্টোদিকে। সেখান থেকে ঘুরতে ঘুরতে থিতু হয়েছে সল্টলেকের সেন্ট্রাল পার্কের একটা নির্দিষ্ট অংশে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে এটাই বইমেলার পাকাপাকি আস্তানা হয়ে গিয়েছে। নামও ঠিক করে দিয়েছেন তিনি, বইমেলা প্রাঙ্গণ। করোনার আগে পর্যন্ত বইমেলার একটা নির্দিষ্ট সময় ছিল। সারা পৃথিবীতে যত বইমেলা হয়, যে সংস্থা সেই বইমেলাগুলির সমন্বয়ে সাধন করে থাকে, সেই সংস্থা সব বইমেলার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সারা বছরের বইমেলার একটা ক্যালেন্ডার তৈরি করত। এখনও করে থাকে। কলকাতা বইমেলার নির্দিষ্ট সময় ছিল জানুয়ারি মাসের শেষ বুধবার থেকে বারো দিন। শুরু থেকে দ্বিতীয় রবিবার পর্যন্ত। তাই হত। অল্প কিছু হেরফের যা হয়েছে তাও আন্তর্জাতিক বইমেলা সংগঠকদের সঙ্গে পরামর্শ করে। বিশেষ করে করোনার পরে। এবারও বইমেলার সময় কিছুটা এগিয়ে আনতে হয়েছে। সেটা এখানকার প্রয়োজনে। এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা কলকাতা বইমেলার আয়োজকদের আর্জি মেনে তা নির্দিষ্ট করেছে।
৪৬ বছর আগে যে ক্ষুদ্র পরিসরে মেলা শুরু হয়েছে হয়েছিল এই ৪৬ বছরে তা আড়েবহরে বিরাট আকার নিয়েছে তো বটেই, আকৃতি প্রকৃতিতেও ব্যাপক হয়ে উঠেছে। এবারে মেলায় লিটল ম্যাগাজিন এবং ছোট বড় স্টল মিলিয়ে হাজার খানেক সংস্থা অংশ নিয়েছে। রাজ্যের অর্থনীতিতে যেমন আমাদের দুর্গাপুজো, কালীপুজো বেশ খানিকটা প্রভাব বিস্তার করেছে, ঠিক তেমনি বইমেলাও এই রাজ্যের আর্থিক বাজারে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। এই কদিনে এখানে বেশ কয়েক কোটি টাকার ব্যবসা হয়। অর্থাৎ লেনাদেনা হয়। কাজেই সেই দিক থেকে দেখলেও আর্থিক বাজারে বইমেলার স্থান এখন বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
তরুণ বয়সে বইমেলা আমাদের কাছে এক দুর্নিবার আকর্ষণ ছিল। তখন মেলায় ঢুকতে গেলে টিকিট লাগত। আশির দশকের গোড়ার দিকে বোধহয় মেলার টিকিটের দাম ছিল ৫০ পয়সা। তখন অবশ্য ৫০ পয়সার বেশ দাম ছিল। কতটা দামি তা বোঝাতে আমি আমার নিজের কথা একটুখানি বলি। তখন বাসের সবচেয়ে কম ভাড়া ছিল ১০ পয়সা। আর বেশি ৩৫-৪০। আমি কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় এক পাবলিশারের কাছে কাজ করতাম। মাস ছয়েক কাজ করেছিলাম। মাসে ১০০ টাকা মাইনে। তাও অনেক বেশি। অনেকে ৬০-৭০ টাকা মাস মাইনেতেও কাজ করত। আর যেদিন অফিসে আসব, সেদিন এক টাকা জলপানি পাব। ওই একটাকাতেই আমার যাতায়াতের গাড়ি ভাড়া ৭০ পয়সা, আর ১০ পয়সায় ৫০ গ্রাম মুড়ি, ১০ পয়সার ভিজে ছোলা এবং ১০ পয়সায় এক গ্লাস চা। টিফিন হয়ে যেত। সেই পাবলিশারের ঘরে চাণক্য সেনের অনেক বই ছিল। কোম্পানিতে ওপরতলার লোক বলতে একমাত্র মালিক, আর আমি সব ব্যাপারে তাঁর সহকারী। তাছাড়াও বাড়তি কাজ ছিল, ঝাড়ুদার ঘর পরিষ্কার করে গেলে তারপর জল ছড়ানো, ঠাকুরকে ধূপ দেখানো থেকে দে নাথ শৈব্যার ঘরে বই পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত। তার বাইরে যেটুকু সময় থাকত সেটুকুই বই পড়তাম। চাণক্য সেন ছিলেন আমার প্রিয় লেখক। এই প্রকাশকের ঘরে চাণক্য সেনের অনেক উল্লেখযোগ্য বই ছিল। ‘মুখ্যমন্ত্রী’, ‘রাজপথ জনপথ’, ‘অরাজনৈতিক’ এইসব। এখানেই কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমি মৈত্রেয়ী দেবীর ‘ন হন্যতে’ বইটা পড়ি। তাছাড়া ওই সময়টুকুর মধ্যেই মৈত্রেয়ী দেবীর লেখা ‘স্বর্গের কাছাকাছি’ বেরিয়েছিল এই প্রকাশনী থেকেই। বইটা তৈরি করার ব্যাপারে আমি ভীষণভাবে জড়িয়ে পড়েছিলাম। নিজের ইচ্ছেতেই। ফলে সেই সময় মৈত্রেয়ী দেবীর সঙ্গে আমার এমন সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল যে ও বাড়িতে প্রায় রোজই যেতে হত। আর গেলে আমাকে কিছু না কিছু খেয়ে ফিরতে হত। এই প্রকাশন থেকে চাকরিটা ছেড়ে দেওয়ার পরও মৈত্রেয়ী দেবীর সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ থেকে গিয়েছিল অনেকদিন।
শুরু করেছিলাম বইমেলার কথা। সেখান থেকে চলে এলাম চাণক্য সেন আর মৈত্রেয়ী দেবীতে। ফিরে যাই বইমেলায়। সেই সময় মেলা এখনকার মতো হইহই মেলা ছিল না। বই যাঁরা ভালবাসতেন, তাঁরা আসতেন প্রায় নিয়মিত। গাঁটের কড়ি খরচ করে টিকিট কেটে ঢুকতেন। আর যত না কিনতেন তার চেয়ে দেখতেন বেশি। এখনও তাই হয়, তবে তখনকার রকম-সকম একটু আলাদা রকমের ছিল।
সেই সময় বইমেলা ছিল সত্যিই লেখক পাঠক প্রকাশকের মিলন মেলা। এখনও তাই আছে, তবে তা এখন অনেক সফিস্টিকেটেড, ঝাঁ চকচকে এবং অনেক বেশি মাত্রায় ব্যবসায়িক হয়ে গিয়েছে। তখন মেলায় প্রকাশক ও পাঠকরা তো থাকতেনই। এবং লেখকদেরও সেই সময় বিকেল-সন্ধের আস্তানা ছিল বইমেলা। লেখকরা প্রতিদিন কাজ শেষে মেলায় আসতেন। নিজেদের মতো ঘুরতেন ফিরতেন। উৎসাহী পাঠকরা বই কিনে নিয়ে এসে তাঁদের কাছে দাঁড়ালে তাঁরা ঘুরতে ঘুরতেই কেনা বইয়ে সই করে পাঠকের আগ্রহ পূরণ করতেন। এখনকার মতো প্রকাশকদের ঘরের ভেতরে বাইরে বসে লেখককে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সই করতে হত না। মেলায় আধুনিকতার সঙ্গে তাল রাখতে সেলফি জোন করতে হয়। এখন সিনেমামেলা, গানমেলা, কিংবা বইমেলা সব মেলাতেই সেলফি জোন থাকে। সেখানে মেলা-জনতা সেলফি তোলে। ঠিক তেমনি বইমেলায় বড় বড় প্রকাশকরা নিজেদের প্যাভেলিয়নের বাইরে সিগনেচার জোন তৈরি করে। সেখানে দফায় দফায় লেখকদের বসিয়ে সইয়ের লোভ দেখিয়ে পাঠককে টেনে আনে।
তখনকার মেলায় একটা আমুদে ব্যাপার ছিল। প্রত্যেকেই প্রাণের আনন্দে মেলায় আসতেন এবং অংশ নিতেন। তখন মেলায় মমার্তঁ বলে ফরাসি ধাঁচে তৈরি একটা এলাকা ছিল। যেখানে শিল্পীরা নিজের খুশিতে ছবি আঁকতেন, গাইয়েরা গিটার বাজিয়ে গান গাইতেন, অনামি চিত্রকররা নিজেদের আঁকা ছবি বিছিয়ে বেচতে বসতেন। এখনও তেমন পরিসর আছে, তবে তার মধ্যে প্রাণের আবেগ কতটা আছে তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।। অনেকটা ব্যবসায়িক এবং কিছুটা আলোর বৃত্তে নিজেকে রাখার উদ্যম।
সেই সময় শিল্পী পূর্ণেন্দু পত্রীকে দেখেছি মেলায় বসে ছবি আঁকছেন, আর আগ্রহী দর্শকরা সেই ছবি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন, যাঁর যেমন সামর্থ্য, সেই দামে। কাউকে কাউকে পয়সা না নিয়েই ছবি উপহার দিচ্ছেন শিল্পী। অন্য অনেক শিল্পীও এমন ভাবে মেলায় অংশ নিতেন। গাইয়ে বাজিয়ে লেখক শিল্পীরা জমিয়ে ভাঁড়ের চা খেতে খেতে আড্ডা জমাতেন, আর তাঁদের ঘিরে থাকত উৎসাহী পাঠকের দল। এখনও লেখকরা আসেন, তবে তাঁদের উপস্থিতি অনেকটাই এজেন্ডা ভিত্তিক। কিছু কাজ থাকলে মেলায় আসেন। সেটা বই সই কিংবা কোনও মঞ্চে সংবর্ধনা নিতে অথবা কথকের ভূমিকা পালন করার জন্য।
গত প্রায় আধা শতকে বইমেলায় বহু কিংবদন্তি লেখক এসেছেন, তারপরে সময় ফুরোলে তাঁরা আর আসতে পারেননি। তাঁদের জায়গা নিয়েছেন পরবর্তী প্রজন্মের লেখকরা। একইসঙ্গে প্রকাশক এবং পাঠকরাও। বইমেলা বাঙালির আর এক পার্বণে পরিণত হয়েছে। এবং সময় পরম্পরায় তা চলতেই থাকবে। তার চরিত্র বদলাবে, কিন্তু ঐতিহ্য হারাবে না। আবার আগামী বছরের অপেক্ষায় থাকব আমরা।