রুনা চক্রবর্তী, নিউজ ওয়েভ ইন্ডিয়া: হুগলির অন্যতম ঐতিহাসিক শহর চন্দননগর। এখানকার প্রধান উৎসব জগদ্ধাত্রী পুজো। বাংলায় জগদ্ধাত্রী পুজো প্রথম কৃষ্ণনগরের শুরু হয়। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র এই পুজো শুরু করেছিলেন। সেখানে থেকেই পরবর্তীকালে এই পুজো আসে হুগলী চন্দননগরে। প্রচারের দিক থেকে কৃষ্ণনগরের তুলনায় অনেকটাই এগিয়ে চন্দননগর।
পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য জায়গায় এই পুজো দু’দিন চললেও এখানকার পুজো দুর্গাপুজোর মতো চারদিনের হয়। প্রতিমা নিরঞ্জনের শোভাযাত্রা ও আলোকসজ্জা চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পূজার বিখ্যাত হওয়ার অন্যতম কারণ। গবেষকদের মতে, আড়ম্বরের দিক থেকে চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর শোভাযাত্রা মুম্বইয়ের গণপতি শোভাযাত্রার ক্ষুদ্র সংস্করণ।
চন্দননগরে অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি এই পুজোর প্রচলন হয়। অধ্যাপক বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘চন্দননগর জগদ্ধাত্রী পুজোর বিবরণ ও কয়েকটি ভুল তথ্যের কথা’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ নয়, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের বিশ্বস্ত অনুচর দাতারাম সুর রাজার অনুদান নিয়ে 1762 সালে প্রথম গৌরহাটি গ্রামে তাঁর বিধবা কন্যার বাড়িতে জগদ্ধাত্রী পূজা অনুষ্ঠান করেছিলেন। প্রথম দিকে এই পুজো ছিল রাজাদের। পরে সামন্ত, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়ে। জানা যায় চন্দননগরের বারোয়ারি পুজোর সময়কাল 1790। উপনিবেশ স্থাপনের উদ্দেশ্যে ফরাসিদের চন্দননগরে আগমনের পরেই এখানে সর্বজনীন জগদ্ধাত্রী পূজার সূচনা হয়।
বৈদিক যুগের পর আধুনিককালে পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে চন্দননগরে প্রথম সর্বজনীন জগদ্ধাত্রী পূজার প্রচলন হয়। সেই সময় চন্দননগর নদীবন্দর দিয়ে প্রধানত তাঁত বস্ত্র রপ্তানি হত। ব্যবসায়ীদের উদ্যোগে গঙ্গার তীরে চাউল পট্টিতে সর্বপ্রথম সর্বজনীন জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু হয়। এজন্য চাউলপট্টিকে আদি পুজো বলা হয়। প্রথম থেকেই পুজো এখানে চারদিনের। এরপর ব্যবসায়ীরা জি টি রোডের পশ্চিমে নিজেদের এলাকায় পুজো শুরু করেন। পরে ব্যবসায়ীরা কিছু দূরে আলাদাভাবে পুজো শুরু করেন। নাম হয় কাপড়েপট্টির পুজো। পরে ময়দাপট্টির ব্যবসায়ীরা চাউলপট্টির কিছু দূরে আলাদাভাবে পুজো শুরু করেন। নাম হয় ময়দাপট্টির পুজো। অপর নাম মাড়োয়ারিপট্টির পুজো। যার পোশাকি ও বর্তমান নাম লক্ষীগঞ্জ চৌমাথা। সবজি বিক্রেতারাও চাউপট্টি থেকে আলাদা হয়ে পুজো শুরু করেন। লক্ষীগঞ্জ বাজার এখানে মুলো বিক্রি হত, সেই স্থানের পুজো শুরু হয়। মুলোপট্টির পুজো নামে পরিচিত সেটি। যার পোশাকি নাম লক্ষীগঞ্জ বাজার। লক্ষীগঞ্জ ব্যবসায়ীদের এই চারটি প্রধান পুজো। পুজোর খরচা বহন করেন ব্যবসায়ীরাই।
এরপর লক্ষীগঞ্জ বাজার ছড়িয়ে প্রথম সর্বজনীন জগদ্ধাত্রী পুজো শহরে বিস্তার লাভ করে বাগবাজারে। এই অঞ্চলে ওড়িয়া ব্যবসায়ীদের বসতি ছিল। তারা নিজেদের পুজো শুরু করেন। বর্তমানে বাগবাজার পুজো বলা হয় একে। পরে তা ছড়িয়ে পড়ে লিচুতলা, গোন্দলপাড়া, বারাসাত তেমাথা, কুণ্ডুঘাট, গোস্বামীঘাট ও শহরের সব জায়গায়। এখন একটি পল্লীতে একাধিক পুজো হয়ে থাকে। কালের বিবর্তনে চন্দননগরের সীমা ছাড়িয়ে এই পুজো তেলিনিপাড়া ও ভদ্রেশ্বর অঞ্চলেও প্রচলিত জনপ্রিয় হয়েছে। প্রথমে চন্দননগর ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল সহ মোট 26টি পুজো হত। এখন পুজোসংখ্যা 142। এরমধ্যে একটি মহিলা পরিচালিত সর্বজনীন পুজো। এছাড়া 20-25টি বাড়ির পুজো হয়ে থাকে। প্রতিবছর তেতুলতলা, গৌরহাটিতে পুজোটিতে 400 বা তার বেশি ছাগ বলি হয়।
আলোকসজ্জা চন্দননগর জগদ্ধাত্রী নিজস্ব গর্ব। এই আলোকসজ্জা আজ বিদেশেও সুখ্যাতি লাভ করেছে। পুজো কমিটিগুলির মধ্যে চলে প্যান্ডেল, আলোকসজ্জার প্রতিযোগিতা। হোমিওপ্যাথির শিশি, লজেন্স, চায়ের ভাঁড়, প্রভৃতি ব্যবহার আজ অতীত। বর্তমানের চলে আসছে আরও নতুন নতুন থিম। অনেকক্ষেত্রে কলকাতার দূর্গা পূজার প্যান্ডেলের থিমের অনুকরণ করা হয়। বেশ কয়েক বছর হল এলইডি লাইট টুনির জায়গা দখল করেছে। দশমীর দিন শোভাযাত্রা চন্দননগর জগদ্ধাত্রী মূল আকর্ষণ। পূর্বে শোভাযাত্রায় সঙসাজ, পুতুল নাচ বিখ্যাত ছিল। এখন পৌরাণিক কাহিনী ও আধুনিক সমাজের নানা ঘটনার প্রতিফলন হয় ট্যাবলোতে। ছোট টুনির সাহায্যে বৈদ্যুতিন আলোয় ফুটিয়ে তোলা হয় ঘটনাবলী। শোভাযাত্রায় লক্ষ লক্ষ লোক সমাগম হয়। বিদেশি পর্যটক, রাজ্যপাল ও মন্ত্রী-আমলারা এখানে আসেন পুজো উপলক্ষে।