রাজ্য বিধানসভা ভোটে প্রথমবার লড়াই করতে নেমে ১৭টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে বিহারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জিতেনরাম মানঝির দল হিন্দুস্তানী আওয়াম মোর্চা সেকুলার। আট দফায় ম্যারাথন নির্বাচন থেকে শুরু করে বঙ্গভোটে হিংসা, উন্নয়ন ও নির্বাচনের সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে নিউজ ওয়েভ ইন্ডিয়াকে একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন হিন্দুস্থানী আওয়াম মোর্চার জাতীয় সম্পাদক ও মুখপাত্র শতদ্রু রায় চট্টোপাধ্যায়।
সদ্য শেষ হয়েছে রাজ্যে ম্যারাথন নির্বাচন। এবারের নির্বাচন সম্পর্কে সার্বিক ধারনা কী হল তোমার?
শতদ্রু: এবারে আমরা ৮ দফায় নির্বাচন দেখলাম। ৩৪ বছরের বাম অপশাসন দেখেছি। এরপর পরিবর্তনের ১০ বছর। মানে ৪৪ বছর অতিক্রান্ত। পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়ন স্তব্ধ। আজকে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের কাছে আপনি চলে যান। পাড়ায় একটি চায়ের দোকানে চলে যান। কতজন অনাহারে রয়েছেন, কতজন চাকরির সন্ধানে জুতোর সোল খুইয়ে ফেলছেন, তাঁদের প্রশ্ন করুন। এবারের নির্বাচন তাঁরা কীভাবে দেখলেন। রাজনৈতিক দলগুলো আসছে, লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, গেরুয়া প্রত্যেকটি দল আসছে, কিন্তু সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের কথা কেউ বলে না। একটা শ্রেণির মানুষ কিছু পেয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। কিছু মানুষ না খেতে পেয়ে গরিব থেকে গরিবতম হচ্ছে। এবারে দেখছি যে লড়াইটা চলছে, সেটা শুধু ব্যক্তিকেন্দ্রিক লড়াইতে চলে এসেছে। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের কোনও উন্নয়নের কথা নেই একজন বলছে ‘জয় শ্রীরাম’, আরও এক দল বলছে ‘খেলা হবে’। বিকাশের কথা নেই, কোনও ডেভেলপমেন্টের অ্যাজেন্ডা নেই। এর ওপর ভিত্তি করে আপনি যদি বলেন, ৮ দফায় ভোট হল, ভোটের উৎসব হল, এতে আখেরে সাধারণ মানুষের কী লাভ হবে? লালের জায়গায় সবুজ, সবুজের জায়গায় নীল,নীলের জায়গায় গেরুয়া। সার্বিক উন্নয়ন কথাটার একটা গুরুত্বপূর্ণ মানে আছে। সেই উন্নয়নটা কী হচ্ছে, আদৌ কি হচ্ছে? এই অবস্থায় আমরা চাইছি বিভিন্ন রঙের যে খেলা চলছে উৎসব চলছে, এটা সমাপ্তি ঘটাতে হবে। এর পরে যাতে সত্যিকারের বিকাশ, সত্যিকারের মানুষের যাতে সুবিধা হয়, তার জন্য আমাদের লড়াই করতে হবে।
হিন্দুস্থানী আওয়াম মোর্চা এবারে ১৭টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে বিধানসভা নির্বাচনে। কেমন ফাইট হল?
শতদ্রু: মাননীয় প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিহারের পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের যশস্বী নেতা মাননীয় জিতেনরাম মানঝি হিন্দুস্থানী আওয়াম মোর্চা সেকুলার পার্টির নেতৃত্বে রয়েছেন। বিহারে জোট সরকারে রয়েছেন। তিনি বিহার বিধানসভার SC, ST ওয়েলফেয়ার কমিটির চেয়ারম্যান। তিনি মাস তিনেক আগে বলেছিলেন, আমরা যে গণ আন্দোলন গড়ে তুলেছি পিছিয়ে পড়া মানুষদের সামনে রেখে। যেভাবে আমরা গোটা বিহার, ঝাড়খন্ড এবং উত্তর প্রদেশে সেই গণ আন্দোলন ছড়িয়ে দিয়েছি, সেটা আমাদের পশ্চিমবঙ্গেও ছড়িয়ে দিতে হবে। ৭৭ বছরের একজন তরতাজা যুবক যিনি নিজে যেসব কেন্দ্রে আমাদের প্রার্থী ছিল সেই ১৭টি কেন্দ্রেই নিজে ও আমাদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব গিয়েছিলেন। বিহার বিধানসভায় হিন্দুস্তানি আওয়াম মোর্চা সেকুলারের ৭ জন বিধায়ক রয়েছেন, এরমধ্যে দুজন মন্ত্রীও। সেইসঙ্গে আমাদের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে বিহার রাজ্যে যেভাবে বিকাশ ঘটিয়েছেন, সেই বিকাশ পশ্চিমবঙ্গেও ছড়িয়ে দিতে আমাদের প্রার্থীরা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দারুণভাবে লড়াই দিয়েছেন। এটা আমাদের প্রথম নির্বাচন। কিন্তু, মানুষের মধ্যে আমরা দাগ কাটতে পেরেছি। বিশেষত, মুর্শিদাবাদের রেজিনগরের আমাদের লড়াই করেছেন হাসানুজ্জামান শেখ এবং হাওড়া উত্তরের অশোক শর্মা খুব ভালো ফাইট দিয়েছেন। এবং ফাইট দিয়েছেন বলেই যেখানে যেখানে আমরা মিটিং করে বেরিয়েছি, তারপরেই তাঁদের ওপর লাল, নীল, হলুদ, সবুজ দলের নেতাকর্মীরা হামলা করেছে। এর মানে আমরা তাদের মনের মধ্যে রেখাপাত করতে সমর্থ হয়েছি।
বিহারে BJP ও JDU-এর সঙ্গে ক্ষমতায় রয়েছে HAM (S)। এরাজ্যেও কি BJP ক্ষমতায় এলে সমর্থন দেবে?
শতদ্রু: প্রথমত হিন্দুস্তানি আওয়াম মোর্চা সেকুলারের সঙ্গে বিহারে জোট রয়েছে JDU-এর। BJP-এর সঙ্গে কিন্তু কোনও জোট নেই। এটা অনেক জায়গায় সাংবাদিকরাও আমাদের প্রশ্ন করেছেন, ভারতীয় জনতা পার্টির সঙ্গে আপনাদের জোট রয়েছে কিনা, সেটা একদমই ভুল। জিতেনরাম মানঝি জি যেদিন JDU ছেড়ে নতুন দল গঠন করলেন, সেই সময় আমাদের ছিল ২৫ জন বিধায়ক। সেই ২৫ জন বিধায়ককে নিয়ে শপথ নিয়েছিলেন একলা চলো নীতির এবং সেই সময় নীতীশ কুমারের যখন অবস্থান খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। তখন আমরা বুঝেছিলাম যে বিহারে নীতীশ কুমারের নেতৃত্বে যে উন্নয়ন ঘটতে চলেছে, গত পাঁচ বছরে যেভাবে উন্নয়নের কাজ করেছেন সব থেকে শ্রেষ্ঠ মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁকে সাপোর্ট দেওয়া যাবে। সেই হিসেবে আমাদের সঙ্গে JDU-এর গটবন্ধন হয়েছিল। ভারতীয় জনতা পার্টির সঙ্গে আমাদের কিন্তু কোনও জোট নেই। পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে যখন প্রথমে পটনা ও পরে কলকাতায় আমাদের কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিং হয়, সেখানে একটাই কথা আমরা কিন্তু সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছিলাম, আমরা ভারতীয় জনতা পার্টিকেও কোনও সাপোর্ট করছি না এবং তৃণমূল কংগ্রেসকেও করছি না। অনেক সাংবাদিকই আমাদের প্রশ্ন করেছিলেন, আপনারা BJP-এর না তৃণমূলের ভোট কাটতে এসেছেন? আমরা বলেছি, আমরা কোনও খেলা হওয়ার কথা বলছি না। জয় শ্রীরামও না। জিতেনরাম মানঝি বিহারে আড়াই বছর মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তিনি যে ধরনের উন্নয়নের কাজ করেছিলেন সেই ডেভেলপমেন্টের কথা তুলে ধরার জন্য আমরা প্রার্থী দিয়েছি এখানে। আপনারা যদি আমাদের প্রার্থীদের আশীর্বাদ করেন, পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় আমাদের প্রার্থীরা যদি জিতে আসেন, তাহলে বিহারে আড়াই বছরে যে উন্নয়ন হয়েছে, সেই উন্নয়নের ধারা এখানেও দেখতে পাওয়া যাবে। সবথেকে বড় কথা যদি উন্নয়ন করতে হলে মানসিকতার উন্নয়নটা আগে করতে হবে। আমরা প্রত্যেকটা জায়গায় বলেছি, ৫ বছর অনেক সময়। পাঁচ মাসে ডেভেলপমেন্ট করে দেখাতে পারি। জিতেনরাম মানঝি সেটা দেখিয়েছেন, রাস্তা থেকে শুরু করে সুশাসন, ওয়ান নেশন ওয়ান এডুকেশনের কথা বলেছিলেন এই আমাদের মাননীয় প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। এই ওয়ান নেশন ওয়ান এডুকেশনের কথা কেউ বলেন না। এজন্য উনি লালকেল্লার মতো জায়গায় ধরনাতেও বসেছিলেন। বিহারে উনি বারবার একথা বলেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে এসেই সেই একই কথা উনি বলেছেন। উওমেন এমপাওয়ার মেন্টের কথা বললেও বলব বিহারের সাসারাম থেকে দ্বারভাঙা, ভাগলপুর, মুজফ্ফরপুর থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রত্যন্ত জায়গাতে গেলে দেখতে পাবেন ঘরে ঘরে কীভাবে মহিলাদের বিকাশ হয়েছে। আজও সকলে জিতেনরাম মানঝিজির কথা সকলে বলেন। জিতেনরাম মানঝিজির নেতৃত্বে হিন্দুস্তানি আওয়াম মোর্চা সেকুলার আগামী দিনেও কলকাতা পুর নির্বাচন ও হাওড়া মিউনিসিপালিটির নির্বাচন ও অন্যান্য সমস্ত নির্বাচনে লড়বে। ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি গঠন হয়ে গেছে। উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা ও দিল্লিতেও গঠন হয়েছে। ত্রিপুরা ও ওড়িশাতে রাজ্য কমিটি গঠন হবে। অর্থাৎ এক সুনির্দিষ্ট সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে আমরা পিছিয়ে পড়া মানুষ এবং শিক্ষিত ও অশিক্ষিত মানুষ সবাইকে নিয়ে ভারতবর্ষে গণ আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি করছি। তারই একটা অংশ পশ্চিমবঙ্গ। মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়ার হাতিয়ার ছিল এই বিধানসভা নির্বাচন। খুব কম সময়েই আমরা ১৭ জন প্রার্থী দিয়েছি। আগামীদিনে ১৪৪টি ওয়ার্ডেই পুরসভা নির্বাচনে আমরা প্রার্থী দেব। ইতিমধ্যেই প্রচুর মানুষ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। আগামীদিনে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হিন্দুস্তানি আওয়াম মোর্চা সেকুলার পার্টির যে নীতি আছে, সেই কথাগুলো পশ্চিমবঙ্গবাসীর কাছে তুলে ধরার জন্য আমরা এখানে এসেছি।
পরিবর্তন না প্রত্যাবর্তন?
শতদ্রু: আমরা বলব উন্নয়ন। পরিবর্তন না প্রত্যাবর্তন তো মার্কশিটের হিসেবনিকেষ পশ্চিমবঙ্গবাসী করবে। ৩৪ বছর ও ১০ বছর মোট ৪৪ বছরের ইতিহাস আপনাকে বলে দিয়েছি। কিসের পরিবর্তন বা প্রত্যাবর্তনের কথা মানুষ বলছে? ‘জয় শ্রীরাম’ বললেই আপনার সরকারি চাকরি হবে? আজকে ঘরে ঘরে মানুষের ডিজে নাইটের মতো ডিজে মিউজিক চালাতে চালাতে প্রচার চলছে ‘খেলা হবে খেলা হবে’। ইলেকশন কি খেলার জিনিস? আমরা জানি যে নির্বাচনী প্রক্রিয়া যেখানে একটা অফ দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল সরকার হবে, যারা মানুষের স্বার্থে কাজ করবে। সেখানে সরকারে ১০ বছর থাকা দল বলছে, ‘খেলা হবে’ সেটার পরিবর্তন চাইছেন? না সেটার প্রত্যাবর্তন চাইছেন? আরেকটা দল ৩৪ বছর লালে লাল করে দিয়েছিল। রক্তে লালে লাল করে দিয়েছিল, মার্ডার থেকে শুরু করে রেপ থেকে শুরু করে রাহাজানি থেকে শুরু করে এমন কেই নেই যাঁরা মার্কসবাদী CPIM-এর মাধ্যমে অত্যাচারিত হয়নি। তাদের প্রত্যাবর্তনের কথা বলছেন? আরেকটি দল। গোধরা দেখেছি, গুজরাট দেখেছি, জয় শ্রীরাম দেখেছি, চোখরাঙানি দেখেছি, গেরুয়ার চাদরের তলাতেও চোখরাঙানি দেখেছি। তাদের প্রত্যাবর্তনের কথা বলছেন? কিসের প্রত্যাবর্তনের কাছে তুলে ধরবেন? আর আপনি হয়ত সেকুলারিজমের কথা তুলে ধরবেন। আমরা বলছি, আমি নিজে ব্রাহ্মণ ঘরের ছেলে। আমি যখন মুর্শিদাবাদের রেজিনগরের মিটিং করছিলাম রাত ৯টায়। আমার প্রার্থী যখন হাসানুজ্জামান শেখ। তাঁর সামনে ৫ হাজার লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাঁকে বলেছি, আমি ব্রাহ্মণ ঘরের ছেলে শতদ্রু রায় চট্টোপাধ্যায়, আমার দুর্গাপুজোতে তুমি এসে প্রসাদ খাবে আর হাসানুজ্জামানের ঈদের দিন ইফতারের আমি গিয়ে বিরিয়ানি খাব। এটাই তো সেকুলারিজমের কথা। এই সেকুলারিজমের কথা জিতেনরাম মানঝি বলছেন। ‘জয় বাংলা’ বললে সেকুলারিজম। একদল মুসলমান তোষণ করছে আর মাথায় টুপি পরলেই মুসলমান হয়ে গেলাম বা নামাবলী পরলেই আমি হিন্দু হয়ে গেলাম। এ কিসের সেকুলারিজমের কথা? গান্ধী, নেহরু, আম্বেদকর, মাতঙ্গিনী হাজরা, ক্ষুদিরাম বোস এনারা কি বলে দিয়ে গেছেন?এই সেকুলারিজম আমরা কেউই দেখতে চাই না।
BJP-এর ধর্মীয় মেরুকরণের চেষ্টাকে বাঙালি কতটা প্রাধান্য দেবে?
শতদ্রু: একদমই নয়। পশ্চিমবঙ্গবাসী এবং বাঙালি মারাত্মক একটা মাটি কিন্তু। বাঙালির মাটি পশ্চিমবঙ্গের মাটি তার কৃষ্টি তার সৃষ্টি তার কালচার তার রুট, শিক্ষা মারাত্মক শক্তপোক্ত জায়গায় রয়েছে। ভারতবর্ষ আজও বলে what bengal thinks today india will thinks tomorrow। সেইসব বিদগ্ধ মানুষ তাঁরা কেউ বোকা ছিলেন না। যদি কেউ ধর্মীয় মেরুকরণের চেষ্টা করে ‘জয় শ্রীরাম’ বলে, যদি কেউ মাথায় হিজাব পরে ইফতারে যায়, তাহলেই কেউ সেকুলার হয়ে যায় না। বিহারে আমরা সরকারে রয়েছে। মাইনরিটি ডিপার্টমেন্ট কী দারুন কাজ করছে। সেখানে সন্তোষ সুমন যিনি আমাদের ক্যাবিনেট মন্ত্রীও। তিনি দারুন উন্নয়নমূলক কাজ করছেন। ঘরে ঘরে চলে যাচ্ছেন। কোথায় শিক্ষা হচ্ছে না, কোথায় স্বাস্থ্য পরিষেবা পাচ্ছেন না, এই তো করোনাকালে বিহারে আমাদের কেন্দ্রীয় কমিটি ও সাত বিধায়ক সব জায়গায় ঘুরে বেরাচ্ছেন। এটাই সেকুলারিজম।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হিজাব পরে তিনি মুসলমানদের সঙ্গে নামাজও পড়েছেন। তাঁকে এবার বিভিন্ন জনসভায় চণ্ডিপাঠ করতে দেখা গেছে। আবার এটা কি সত্যিই সেকুলার না ছদ্মবেশ?
শতদ্রু: মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী তাঁর নিজের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কীভাবে নিজেকে মানুষের কাছে তুলে ধরছেন সেটা তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার। সেখানে আমরা কিছু বলতে চাই না। কিন্তু, সজাগ ও সচেতন পশ্চিমবঙ্গবাসী জানে তারা বোঝে কোনটা মেকি, কোনটা ধাপ্পাবাজি, কোনটা ঠিক, কোনটা বেঠিক। সেখানটাতে কীভাবে কোথায় ভুলভাল স্তোত্র পাঠ করবেন, কোথায় ভুলভাল হনুমান চালিশা পড়বেন, ভুলভাল মাথায় হিজাব পরে কোরানের বাক্য দেবেন সেটা সাধারণ মানুষ বিচার করবেন। আগামীদিনে সেকুলারিজমের তত্ত্ব ও সেকুলারিজমের ভাষা কিন্তু নতুন রূপরেখা তৈরি করবে। যারা মনে করছে যে ‘জয় শ্রীরাম’ বললে সেকুলারিজমের মারাত্মক জায়গায় মাইনরিটিকে আলাদা করে দাও, তা হয় না। মানুষ খুব সচেতন। শিক্ষিত মানুষ এর যোগ্য জবাব দেবেন।
রাজ্যে BJP কী সাংগঠনিকভাবে মজবুত? না পুরোটাই হাওয়া তোলার রাজনীতি?
শতদ্রু: আমি আমার নিজের পাড়ার কথা বলছি। যিনি প্রার্থী হয়েছেন আমার নিজের বিধানসভাতে তিনি অলিগলি রাস্তা চেনেন না। নির্বাচনের ১৫ দিন আগে তাঁকে প্রার্থী করা হয়েছে। ১০ থেকে ১৫টা ছেলেকে নিয়ে তাও বাইরের ছেলেকে নিয়ে ঘুরে বেরাচ্ছে আমার বিধানসভায়। আপনি এবার বলুন যে তিনি কি প্রার্থী? তাঁর সংগঠনের জোর কোথায়? আর একটি কথা বলি, হাওড়া উত্তরে আমার নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ছিলাম আমাদের প্রার্থীকে নিয়ে। আমরা ছোট দল। ৭০ থেকে ৭৫টা ছেলেকে নিয়ে গেছিলাম, যাঁরা জেনুইন হাওড়া উত্তরের ছেলে। কিন্তু, এই ভারতীয় জনতা পার্টির মতো দল এবার উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথকে নিয়ে জনসভা করছে, সেখানে হাজারখানা লোকের মধ্যে নশো নিরানব্বই জন কিন্তু বিহার, ঝড়খণ্ড থেকে আসা। আমরা সংগঠনে বিশ্বাসী। যারা ভাওতাবাজি দিয়ে একটা মিডিয়া হাইপ করে ২০০ আসন জেতার কথা বলছে। আমি বলছি না, সাধারণ মানুষ বলছে। ২ তারিখ বুঝে যাবেন রেজাল্ট কী হয়েছে। তাহলে তো ফেসবুকে বসে বসে আমি ঘরে বসে সরকার গঠন করে ফেলি। আপনি মন্ত্রী হয়ে যাবেন, আপনিই প্রধানমন্ত্রী হয়ে যাবেন। আমিও প্রধানমন্ত্রী হয়ে যেতে পারি। ওতো সোজা। মাঠে ময়দানে নামতে হবে। মাঠে ময়দানে নেমে মানুষের পালস বুঝতে হবে। ১৫দিন আগে একটা দল করলাম আর কারা BJP-তে এসেছে বলুন তো? যারা একসময় CPM করেছে, তারাই তৃণমূলে গেছে, কিছু না পেয়ে তারা আবার BJP-তে যোগ দিয়েছে। এবং তার মধ্যে আবার খেওখেই। যারা টিকিট পেয়েছে সেখানে আবার আদি আর নব্য ভাগ হয়ে গেছে। সিঙ্গুরে রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য একজন শিক্ষিত মানুষ। তিনি TMC ছেড়ে BJP-তে গেছেন। আর প্রার্থী হিসেবে নাম ঘোষণার পরেই আদি BJP-র লোকজনরা এসে বাড়ির সামনে বোমাবাজি করে গেল। শঙ্কর ঘোষ। CPIM-এর দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা। জেলা কমিটির নেতা। কেন্দ্রীয় কমিটিতে রয়েছেন। শঙ্করের সঙ্গে কয়েকদিন আগেও আমার কথা হল। হঠাৎ একদিন সকালে খবরের কাগজে দেখলাম BJP থেকে দাঁড়িয়েছেন। এভাবে সংগঠন হয়? শুভেন্দু অধিকারী থেকে রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় আপনারাও জানেন আমরাও জানি ওনারা কেন TMC ছেড়ে বিজেপিতে গেছেন। যদি এরকমই হত, তাহলে ঘরে ঘরে সরকার গঠন হয়ে যেত।
এবারের ভোট কি খুব বেশি কুৎসা ও অপপ্রচারের ভোট?
শতদ্রু: একদমই একদমই। আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠদের দেখতাম। তখন আমরা উদাহরণ দিতাম। পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনে কত ধরনের বক্তব্য শুনতাম। আর এখন একদিকে ‘জয় শ্রীরাম’ আর একদিকে ‘খেলা হবে খেলা হবে’। ব্যক্তিগত কুৎসা, কোনও আইডিওলজির কথা নেই, কোন উন্নয়নের কথা নেই, কোনও পলিটিক্যাল অ্যাজেন্ডা নেই, কোনও সোশ্যাল কমিটমেন্টের কথা নেই, কোনও ইকনোমিক্যাল আপলিফমেন্টের কথা নেই, কোনও মাইনরিটি ডেভেলপমেন্টের কথা নেই, কোনও শিক্ষার পরিকাঠামোর কথা নেই। দেড় বছর ধরে প্যানডেমিক চলছে, পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের কী হাল? শুধু ডিম ভাত খাওয়া। আর সরকারি শিক্ষকশিক্ষিকারা মাইনে পেয়ে যাচ্ছেন। যেসব শিশুদের বেসরকারি স্কুলে ভর্তি হওয়ার টাকা নেই তারাই ভুক্তভুগী হচ্ছে। কোনও জায়গায় ঠিকমতো পরিকল্পনা নেই। জেলায় জেলায় নাকি মাল্টি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল হয়েছে। তাই যদি হতো, তাহলে প্রতিদিন ফেসবুকে আমাদের দেখতে হত না, ১০০ বা ২০০ বেড বাড়ানো হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর পা ভেঙেছে, ২ থেক ৩ সপ্তাহ লাগে পা ঠিক হতে। ওনার পা মচকেছে, দেড় মাস লেগে গেল পা ঠিক করতে। এই যে ধাপ্পাবাজি, প্রহসন চলছে তাই আপনি যে জানতে চাইলেন প্রত্যাবর্তন না পরিবর্তন? না, নতুন দিশা, নতুন আলো নতুন সংগঠনের রূপরেখা নতুনভাবে তৈরি করতে হবে। এবং অনেক ছাত্র যুব এখনও স্বপ্ন দেখেন রাতের পর নতুন সূর্যোদয় হবে। সেই লক্ষ্যে আমরা লড়ছি এবং মাননীয় জিতেনরাম মানঝির নেতৃত্বে আমরা বার্তা পৌঁছে দিতে এসেছি।
বিহারে ক্ষমতাসীন BJP-JDU-HAM জোট। সেখানেও অনেক উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে বলে শোনা যায়। এরাজ্যেও অনেক উন্নয়নের কাজ হয়েছে বলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি। উন্নয়নের নিরিখে দুই রাজ্য কোথায় এগিয়ে বা কেন এগিয়ে?
শতদ্রু: প্রথমত হচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা। আমরা বিহারে বাইরে থেকে দেখে মনে করি বিশাল খারাপ। যারা বিহারে থাকে, ঝাড়খণ্ডে থাকে, তারা দেখলে বুঝতে পারবে যে কতটা কীভাবে উন্নয়ন হয়েছে। আজও আপনি বিহারের যেকোনও প্রান্ত যেকোনও জায়গা থেকে গাড়ি নিয়ে আপনি আসুন, দেখবেন চারিদিকে পুলিশ প্যাট্রলিং চলছে। গুন্ডামি, মস্তানি সব বন্ধ হয়ে গেছে। এটা জিতেনরাম মানঝির নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল। পরবর্তীকালে জোট সরকারের শাসনে প্রতিটা পুলিশ প্রশাসনের আধিকারিকের কাছে আপডেট আসে। আমরা জানতাম বিহারে নাকি ভোটে গুন্ডামি, মস্তানি হয়। একদম ভুল কথা। নির্বাচনের দিন গায়ে কারো হাত পড়ে না। এটা কি কেউ জানে? কিন্তু, পশ্চিমবঙ্গে সারাক্ষণ কাটছে, মারছে, ধরছে। তার মানে আইনশৃঙ্খলার অবনতি। ৩৪ বছর ও ১০ বছর। মানে ৪৪ বছরে আইনশৃঙ্খলা একদম শেষ। আর স্বাস্থ্য ব্যবস্থার হাল তো দেখতেই পাচ্ছি। কলকাতাকে আমরা বলি মেট্রোপলিটন সিটি। পাটনা মেট্রোপলিটন সিটি নয়। আমরা এডুকেশনের দিক থেকে যদি দেখতে চাই তাহলে কলকাতা একাডেমিক এবং এডুকেশন এর দিক থেকে এগিয়ে ছিল। কেন আমি তা বলছি? গত দু-তিন বছরে বিশেষত প্যানডেমিক পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষায় অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে। যেখানে বিহারের অনলাইন সিস্টেম অনেক এগিয়ে গেছে। এরপরে এখানে কোনও কাজ করতে গেলে কাটমানি এবং আন্ডার টেবিল গেম। সেখানে বিহারে মুখ্যমন্ত্রী তার পারিষদদের নিয়ে নিয়মিত বিভিন্ন জায়গা পরিদর্শন করেন। কোথায় কাটমানি খাওয়া হচ্ছে কিনা সেইদিকে নজর রাখেন। এবং আমজনতা দরবার করেন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন। এখানে ‘দিদিকে বলো’তে ১০ হাজার বার ফোন করেও তাঁর কানে কথা পৌঁছে দেওয়া যায় না। সব ভাই আর ভাইপো অবধি দিয়ে থেমে যায়। আর তারপরেই গল্প চলে আসে কাটমানির। এবার রাস্তাঘাট। নতুন সরকার আসার পর বিহারে যেকোনও প্রান্ত থেকে ৬ ঘণ্টায় পটনায় পৌঁছনো সম্ভব হবে এরকম রাস্তাঘাট তৈরি করা হয়েছে। স্বাস্থ্যবিভাগে কী দারুন কাজ হয়েছে বিহারে। AIIMS কী দারুন কাজ করছে সেখানে। আমাদের এখানে কল্যাণী AIIMS-এ কজন যাচ্ছে? আমি কলকাতার বাসিন্দা হয়ে আমার গর্ব করা উচিত ছিল। কিন্তু, দুঃখের বিষয় তা পারছি না। বিহারের দ্বারভাঙা, ভাগলপুরে মাল্টিসুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে দারুন পরিষেবা পাচ্ছে মানুষ। এটা ঠিক একটা সময় বিহার পিছিয়ে পড়া রাজ্য ছিল। একটা সময় ট্রেনে লোকে যেতে ভয় পেত। ট্রেন ঝাঁঝা ক্রশ করলেই ডাকাতির হত। এখন পুলিশ প্রশাসন কড়া হাতে মোকাবিলা করছে সব। সুশাসন এবং প্রশাসনের সহায়তায় গ্রামে-গঞ্জে দিয়ে নির্ভয়ে যাতাযাত করছে মানুষ।
ভোটের ফল কী হবে বলে আপনার ধারনা?
শতদ্রু: আমি একদম বাস্তবের মাটিতে পা রেখে চলি। আমি গণতকার নই। জেলার যেখানে যেখানে গেছি, আমাদের জেলা কমিটির সভাপতি, প্রার্থীদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। আমি নিজে কলকাতা ছাড়াও মুর্শিদাবাদ, মালদায়, হাওড়ায় প্রচারে গেছি। মানুষ যেটা চাই সেটা হচ্ছে উন্নয়ন। চাইছে কাজ, চাইছে পেটে ভাত। SB রিপোর্ট, IB রিপোর্ট কিছু হয় না। ঠাণ্ডা ঘরে বসে রিপোর্ট তৈরি হয় না। মানুষের কাছে গেলে আপনি হাতে হাতে রিপোর্ট পেয়ে যাবেন। ৭০ থেকে ৮০টা আসন ভারতীয় জনতা পার্টি পাচ্ছে। ৩০-৩৫টা আসন সংযুক্ত মোর্চা পাবে। বাকি আসন তৃণমূল কংগ্রেস পাচ্ছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্ব তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতা আসছে তৃণমূল সরকার। নন্দীগ্রামে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০ থেকে ২৫ হাজার ভোটে জিততে চলেছেন। আপনি মিলিয়ে নেবেন। ইতিমধ্যে নতুন মন্ত্রিসভায় কারা কারা থাকবে সেই নিয়ে কিন্তু ৩০বি হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে কিন্তু আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। এবং অনেক নতুন নতুন মুখ দেখবেন। আমি নাম বলতে চাই না, তাও বলছি কৌশানি থেকে কাঞ্চন মল্লিক থেকে শুরু করে জাভেদ খান ভালোভালো ক্যাবিনেট পাবেন। আপনি আমার কথা মিলিয়ে নেবেন। ২ মে ২টোর পর আপনার সঙ্গে কথা হবে।