রুণা খামারু: দেশজুড়ে শুরু হল বিকশিত কৃষি সংকল্প অভিযান (Viksit KrishiSankalp Abhiyan)। আধুনিক কৃষি কৌশল, উদ্ভাবনী ও সুস্থায়ী কৃষি পদ্ধতির মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন বাড়িয়ে কৃষকদের সাফল্যের মুখ দেখাতেই নতুন এই কর্মসূচি নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। ২৯ মে থেকে শুরু হওয়া এই অভিযান চলবে ১২ জুন পর্যন্ত। এতে গোটা দেশের ৭০০-টিরও বেশি জেলার ২০০০-এর বেশি বৈজ্ঞানিক সরাসরি কথা বলবেন দেশের প্রায় দেড় কোটি কৃষকের সঙ্গে। কৃষি গবেষণা ও বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি কৃষকদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতেই এই উদ্যোগ। এতে কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে কৃষকদের সম্পর্ক আরও মজবুত হবে বলেই আশা করা হচ্ছে। কৃষি মন্ত্রণালয় ও ভারতীয় কৃষি গবেষণা পরিষদের (ICAR) নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গেও‘বিকশিত কৃষি সংকল্প অভিযান’ সফল করতে জেলায় জেলায় উদ্যোগী ভূমিকা নিচ্ছে কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রগুলি (KVK)। কৃষি বৈজ্ঞানিক ও বিশেষজ্ঞদের টিম নিয়ে বিভিন্ন জেলার গ্রামে গ্রামে কৃষকদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছেন কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত বৈজ্ঞানিকরা।
এই অভিযান চলছে হাওড়া জেলাতেও। হাওড়া কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রের বরিষ্ঠ বৈজ্ঞানিকও প্রধান ড. কিরণময় বাড়ৈ-এর তত্ত্বাবধানে ২৯ মে সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত গ্রামে গ্রামে কৃষকদের কাছে পৌঁছে গিয়ে এই অভিযানের সেশন পরিচালনা করা হচ্ছে। হাওড়া জেলার জগৎবল্লভপুরের গোয়ালপোতা কিরণময়ী নিম্ন বুনিয়াদী বিদ্যালয়ে ‘বিকশিত কৃষি সংকল্প অভিযান’-এর শুভ সূচনা হয়। সেখানে খারিফ শস্য চাষের কৃষি পরামর্শ সংক্রান্ত একটি কৃষি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। ড. কিরণময় বাড়ৈ জানান, তিনটি টিমে ভাগ হয়ে গিয়ে প্রতিদিন জেলার বিভিন্ন জায়গায় ছটি করে কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে এই অভিযানের অধীনে। প্রতিটি টিম দু’বেলা দুটি করে সেশন পরিচালনা করছে। এই সেশনগুলিতে বর্ষা শুরু আগে খারিফ মরশুমে কৃষিকাজের আধুনিক কৌশল সংক্রান্ত বিষয়ে কৃষকদের সচেতনতা বৃদ্ধি; আলোচনা করা হচ্ছে কৃষি সংক্রান্ত বিভিন্ন যোজনা ও নীতি নিয়ে; বৃষ্টিপাতের পরিমাণ, কৃষি-জলবায়ুর পরিস্থিতি ও মাঠের ধরন নিয়ে আলোচনা; মাটির স্বাস্থ্য পরীক্ষা কীভাবে করা উচিত তাও জানানো হয়। সেইসঙ্গে আধুনিক বপন কৌশলের সুপারিশ করে জৈব চাষে আরও উৎসাহিতকরা হয় কৃষকদের। পাশাপাশি সেখানে শোনা হচ্ছে কৃষকদের নানান সমস্যার কথাও এবং তা সঙ্গে সঙ্গে সমাধানের উপায়ও বলে দেওয়া হচ্ছে সেশন চলাকালীন আলোচনায়। এছাড়া কৃষিক্ষেত্রের উন্নতিতে বাড়ির মহিলাদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে তাঁদের ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদনের পরামর্শও দেওয়া হয়। তিনি বলেন, “এই অভিযানে হাওড়া জেলার ১৪টি ব্লকের গ্রাম ও মাঠে মাঠে পৌঁছে যাচ্ছেন বৈজ্ঞানিকরা। খারিফ মরশুমে ফলনের বৃদ্ধিতে জোর দিতেই এই উদ্যোগ।” এও জানান, এই অভিযানে তাঁদের সহযোগী হিসেবে রয়েছে ICAR-National Institute of NaturalFibre Engineering and Technology (NINFET) ও ICAR-Central Research Institute for Jute and Allied Fibres (CRIJAF)।
কর্মসূচিতে উপস্থিত প্রতিনিধিদের মধ্যে ছিলেন ICAR-NINFET-এর মুখ্য বৈজ্ঞানিক ও বিভাগীয় প্রধান ড. দেবপ্রসাদ রায়। সার্বিক উন্নয়নের জন্য কৃষিক্ষেত্রের বিকশিত হওয়া কতটা জরুরি তা জানান তিনি। প্রযুক্তির ব্যবহারে কৃষিতে উন্নয়নের দিকগুলিওতুলে ধরেন উদাহরণ দিয়ে। সেইসঙ্গে জানান, শুধু পাট নয় আরও লাভজনক যেসব চাষ রয়েছে সেদিকেও নজর দিতে হবে কৃষকদের। যেমন কলা গাছের তন্তু থেকেও রকমারি সামগ্রী তৈরি হচ্ছে। তাই চাষিদের এর সুফল সম্পর্কে আরও সচতেন হতে হবে।
ব্যারাকপুরের CRIJAF-এর তরফে উপস্থিত বৈজ্ঞানিক ড. কে জি মণ্ডল কৃষকদের স্কিল ডেভেলমেন্টের উপর বিশেষভাবে জোর দেন। কৃষকরা কীভাবে আধুনিক কৃষিকৌশলকে হাতিয়ার করে ভালো মানের ফসল উৎপাদনের পথে আরও এগিয়ে যেতে পারেন সেনিয়ে আলোচনা করেন তিনি।
উপস্থিত ছিলেন হাওড়া জেলা প্রাণী সম্পদ উন্নয়ন দপ্তরের ডেপুটি ডিরেক্টর ডঃ স্বরূপ বক্সী। পশু প্রতিপালন নিয়ে কৃষকদের সচেতন করেন তিনি। চাষ যে এখন আর শুধুমাত্র জমিতে ফসল উৎপাদনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই বরং প্রাণী প্রতিপালন, মৌমাছি, মাছ চাষও এর মধ্যে রয়েছে তা নিয়ে কৃষকদের অবহিত করেন তিনি। সেইসঙ্গে গবাদি পশুর বর্জ্য জৈব সার তৈরিতে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তাও তুলে ধরেন। এছাড়া লিঙ্গ-নির্ধারিত গো-বীজ ব্যবহার করে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে বকনা বাছুরের জন্ম যে সুনিশ্চিত করা গেছে সেকথাও তুলে ধরেন।
‘বিকশিত কৃষি সংকল্প অভিযান’ কর্মসূচি পরিচালনা করার পাশাপাশি কৃষিকাজে রোগপোকা দমন ও জৈব সারের ব্যবহার নিয়ে কৃষকদের অবহিত করেন হাওড়া KVK-র বৈজ্ঞানিক ড. অর্ক সামন্ত। জানান, বিস্তীর্ণ হাওড়া জেলার উদয়নারায়ণপুর, জগৎবল্লভপুর ও বাগনানেই মূলত কৃষিক্ষেত রয়েছে। সেই মোতাবেক ১৫ দিনের এই কর্মসূচিতে জেলার প্রায় ৪০ হাজার কৃষকের কাছে পৌঁছে যাবে হাওড়া কৃষি বিজ্ঞানকেন্দ্র। এক একটি এলাকা এক একরকম চাষ যেমন – ধান, আলু, সবজি ও ফুল চাষের জন্যে প্রসিদ্ধ। তাই সেই মতো চাষিদের প্রয়োজনীয় সবরকম পরামর্শ ও সহায়তা দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
বৃহস্পতিবার ওড়িশার পুরি কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র (KVK) থেকে দেশজুড়ে এই ‘বিকশিত কৃষি সংকল্প অভিযান’-এর সূচনা করেন কেন্দ্রীয় কৃষি ও কৃষক কল্যাণ এবং গ্রামীণ উন্নয়ন মন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান। হাওড়া জেলায় কৃষকদের সঙ্গে সেশন চলাকালীন কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রীর ভাষণও শোনানো হয় কৃষকদের। বৈজ্ঞানিকদের পরামর্শ পেয়ে অনেকটাই উপকৃত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন জেলার অংশগ্রহণকারী চাষিরাও।