বাংলার কৃষিকৃষ্টির বারোমাস্যা
Share it

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী

কবি মুকুন্দ চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে বৈশাখ-কেন্দ্রিক বারোমাস্যার ছবি পাই। একসময় ফাল্গুনি পূর্ণিমার তিথিতে নববর্ষ উৎযাপিত হত। দোলযাত্রা ছিল তার ধারক ও বাহক। ফাল্গুনি পূর্ণিমার পর চৈত্র মাসকে প্রথম মাস ধরে বারোমাসের হিসেব হত। তার মিসিং লিঙ্ক বাংলার বারোমাসি ছড়াতে। “চৈত্র মাসে বাসন্তী পূজায় ধুমধাম বেশ,/বৈশাখ মাসে বছর আরম্ভ, চৈত্রেতে শেষ।“ আর একটি বারোমাসি কৃষি ছড়া এভাবে শুরু হয়েছে — “চৈতে গিমা তিতা,/বৈশাখে নালিতা মিঠা,/জ্যৈষ্ঠে অমৃত ফল।” দুই ক্ষেত্রেই চৈত্রের কথা আগে এসেছে।
বাঙ্গলায় নববর্ষ উৎযাপনের ঘরানা নানান সময়ে পৃথক ছিল। প্রথম, শরত-অন্তিম নববর্ষ, যেখানে কার্তিক বা অগ্রহায়ণ বছরের শুরু এবং নবান্ন তার ভিত্তি। দ্বিতীয়, বসন্ত-ভিত্তিক বা বসন্ত-সমাপনান্তের নববর্ষ, যেখানে কৃষক নব আনন্দে জেগে কৃষিকাজের উদ্যোগী। প্রথমটি ফসলোত্তর নববর্ষ আর দ্বিতীয়টি প্রাক-ফসলী নববর্ষ।
কালচক্রের একটি বিশেষ সময়ের ফিরে আসাই নববর্ষ। প্রকৃতির নানান সংকেতে, নানান সাজে তা ফিরে ফিরে আসে। বছর আসে আপন রূপ-বৈচিত্র নিয়ে। বাঙলা ক্যালেন্ডারে বর্তমান নববর্ষ পয়লা বৈশাখ। চৈত্রের চিতাভষ্ম উড়িয়ে এই বৈশাখ। ধরা পড়ে বিশ্বপ্রকৃতির পরিবর্তন, রূপবৈচিত্রের প্রভেদ। “কাল যে কুসুম পড়বে ঝরে
তাদের কাছে নিস গো ভরে
ওই বছরের শেষের মধু
এই বছরের মৌচাকেতে।”
নববর্ষ পুরনো বছরকে বাদ দিয়ে নয়; বরং বলা যায়, পুরনো দুঃখ-সুখ, আনন্দ-বেদনার ধারাবাহিকতা নিয়েই বর্ষবরণ।
ওই যে আদিবাসীদের ‘বাহা পরব’; ওটাও নববর্ষ ধারণা, নব বসন্তের পুষ্প পরিণতি। তা অনুষ্ঠিত হয় ফাল্গুনি পূর্ণিমার কাছাকাছি সময়ে। যখন পয়লা বৈশাখের আগে অঘ্রাণ মাসে শুরু হত নববর্ষ, নবান্নের কথা স্মরণ রেখেই মার্গশীর্ষ মাস ছিল অগ্রহায়ণ। কারণ ‘অগ্র’ শব্দের অর্থ ‘সামনে’আর ‘হায়ণ’ কথাটির মানে ‘বৎসর। কাজেই বছরের গোড়ার মাস অঘ্রাণ। ফসলের ভরা মরাই নিয়ে চাষি নববর্ষের আনন্দে মাতবেন এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। কার্তিকের অন্নাভাবের পর নবান্নের ফসলপ্রাপ্তি, আর তারই প্রেক্ষিতে নববর্ষের সূচনা। ‘নবানে-নববর্ষ’-এ রয়েছে নানান লৌকিক আচার-সংস্কার, হিন্দু-বিশ্বাসের নানা আঙ্গিক, ধান্যলক্ষ্মীর পুজো।
বসন্ত-বন্দনার মাধ্যমে নববর্ষের সূচনা বনবাসী-কৌমসমাজের প্রাচীন রীতি ছিল। বনবাসীদের ‘বাহা পরব’ পুষ্পোপাসনার মধ্যে আগামীদিনে খাদ্যের প্রতিশ্রুতি। ফুল থেকে আসবে ফল। “ফুল কহে ফুরারিয়া, ফল, ওরে ফল,/কতদূরে রয়েছিস বল মোরে বল।/ফল কহে, মহাশয়, কেন হাঁকাহাঁকি, /তোমার অন্তরে আমি নিরন্তর থাকি।” এই যে রূপান্তরের নান্দনিকতা, এটাই খাদ্য-সংস্কৃতি। বাহা পরবে তাই শস্য পাবার আকাঙ্খা এবং তারই প্রেক্ষিতে নববর্ষ আহ্বান।

খনার বচনে দেখতে পাই, “ফাগুনে আগুন চৈতে মাটি/বাঁশ বলে শীঘ্র উঠি।” ঝরে পড়া, খসে পড়া পাতায় আগুন লাগিয়ে, তার ছাই মাটিতে মিশিয়ে পটাশ ও জৈব অঙ্গারের জোগান দেওয়া এক পুরাতন কৃত্য এবং বর্ষবরণের অঙ্গ। দোল ফাগুনের পূর্বরাত্রে হোলিকা রাক্ষসীকে পুড়িয়ে মারার উৎসব বা ‘চাঁচড়’ একরকম বনফায়ার। আদিম মানুষের যাযাবর জীবনে জঙ্গল পুড়িয়ে তার ছাইয়ে ফসলের দানা ফেলে কৃষিকাজ সম্ভবত সেই বনফায়ারের আদি কথা। এভাবেই শুরু হত চাষের নতুন মরশুম। যেহেতু কৃষ্টির সঙ্গে কৃষির যোগ থাকে, তাই এই স্প্রিং-ফেস্টিভ্যালকে নববর্ষের দ্যোতক হিসাবে ভাবা যায়। উর্বরা বসুন্ধরা মায়ের কাছে আত্মনিবেদনের উৎসব ছিল নববর্ষ। নতুন বছরে নতুন করে কোমর বাঁধতে হবে, জমি তৈরি করতে হবে, বর্ষার জল ধরে রাখার জলাধার কাটতে হবে। বছরের প্রথম মাসে ভেষজ-তেতো খাবার প্রচলন ছিল। পয়লা বৈশাখেও নিম-মুসুরির মণ্ড খাবার প্রচলন আছে। শরীরকে মজবুত রাখতেই এই তিতো ভক্ষণ।
চৈত্র মাসের শুক্ল প্রতিপদ তিথিটিকে বছরের প্রথম দিন হিসাবে দেশজুড়ে পালন করার হিন্দু সনাতনী রীতি বহুদিনের। এই দিনটির নাম বর্ষ প্রতিপদা; চান্দ্র মাস অনুসারে বর্ষগণনার এক প্রাচীন পরাম্পরা যাতে শুক্লপক্ষের প্রতিপদ তিথি থেকে অমাবস্যা পর্যন্ত এক একটি মাস বিবেচিত হয়। দেশের নানা প্রান্তে এই দিনটি মহা সমারোহে পালিত হয়, গ্রহণ করা হয় প্রতীকী খাদ্য। দাক্ষিণাত্যে নিমফুল, গুড়, মরীচ, তেঁতুল, ও কাঁচা আম দিয়ে তৈরি হয় বর্ষবরণের খাবার, যার উপাদানগুলির স্বাদ আলাদা। ছয় রকমের স্বাদে ছয়টি পৃথক ভাবনা সম্পৃক্ত — তিক্ত নিম দুঃখের প্রতীক, মিষ্ট গুড় আনন্দের প্রতীক, মরীচের ঝাল ক্রোধ, লবণ ভয়, টক তেঁতুল বিরক্তি ও কষা কাঁচা আম বিস্ময়ের প্রতীক। এককথায় জীবনের নানান আবেগ এবং সুখ-দুঃখের নানান পরিস্থিতির এক রূপক-সাংকেতিক খাদ্য-ভাবনা।
বাংলার ব্রতগুলি কৃষি-গ্রামীণ মনস্কামনার স্বরূপ; ফসল উৎপাদন সহ মানুষের নানান কামনা চরিতার্থতার অন্যতম ক্রিয়াকর্ম।
নানা যুগের নানান আঁচড়, যে আবরণগুলি সরালে বেরিয়ে আসে আবহমান ভারতবর্ষের কৃষি সংস্কৃতির এক শাশ্বত রূপ। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, “চিনির ডেলার আকারে কুইনাইন পিল।” এ এক অনন্য নীতিশিক্ষা আর ধর্ম-সংস্কৃতির প্রাথমিক স্কুল, বিদেশি কিণ্ডারগার্টেন প্রণালীর মতোই ভারতীয় নিজস্ব শিক্ষাব্যবস্থায় এক একটি ক্লাসের বই ছিল বাংলার ব্রত। গৃহ, সমাজ, রাষ্ট্র, সংস্কৃতি, প্রকৃতি, জমি-জিরেতের প্রতি আমাদের কর্তব্যবোধের সহজ সরলতা ব্রতের কৃত্য, চিত্র, পদ্য ও উপাখ্যানের মধ্যে ছড়িয়ে রয়েছে। তাই আলোচনার শুরুতে দুই একটি ব্রতের প্রসঙ্গ উত্থাপন করা বোধহয় অত্যুক্তি হবে না।
বসুধারা ব্রত
চৈত্র সংক্রান্তির দিনটি থেকে শুরু হয় বসুধারা ব্রত। গ্রীষ্মের চরম দাবদাহকে মনে রেখেই এই ব্রত। গৃহাঙ্গনে রোপিত গাছগুলিকে সূক্ষ্ম জলের ধারা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার এক হিন্দু ব্রত ও আচার। ”বসুধারা’ মানে পৃথিবী অথবা পৃথিবীর জল-সম্পদের স্রোত।
ভারতের নারীরা পারিবারিক মঙ্গলের জন্য চৈত্র সংক্রান্তি থেকে টানা একমাস তুলসীমঞ্চতে তুলসীধারার ব্যবস্থা করেন। একটি মাটির হাঁড়িতে তলায় ছোটো একটি ফুটো করে, তাতে পলতের কাপড় প্রবেশ করিয়ে অতি ধীর ধারায় সেচের বন্দোবস্ত করেন তারা, একে বিন্দুপাতি সেচ বলা যেতে পারে, ইংরাজীতে Drip Irrigation। ভারতীয় নারী যে বসুধারা ব্রত পালনের অঙ্গ হিসাবে স্নান সেরে সেই ঝারায় জল ঢালেন এবং তুলসী পূজন করেন তাও তুলসী নামক এক পবিত্র ও ভেষজ উদ্ভিদের প্রতি ধন্যবাদাত্মক চিন্তন।
বসুধারা ব্রতে বাঙালি নারী আবৃত্তি করেন, “তুলসী তুলসী নারায়ণ / তুমি তুলসী বৃন্দাবন /তোমার শিরে ঢালি জল/ অন্তকালে দিও স্থল।” যেন জীবনকালে এ এক মহার্ঘ ভেষজ আর অন্তিমকালেও জীবনের মায়াজাল থেকে মুক্তির মহৌষধি; বাংলার ব্রতেও তারই পুণ্য-পূজন। কবি অক্ষয় কুমার বড়াল ‘এষা’ কাব্যগ্রন্থে লিখছেন, “তোমার নিঃশ্বাসে / সর্বরোগ নাশে/যায় দুঃখ পলাইয়া।” নানান ব্যাধিতে বনবাসী কৌম সমাজ তুলসীর ব্যবহার করে থাকে; কখনো এর ব্যবহার সর্দিকাশিতে, কখনো লিউকোডারমা-র চিকিৎসায়, কখনো দাঁদের ক্ষত দূর করার জন্য কখনো বা ম্যালেরিয়া ঘটিত জ্বরনাশক রূপে।
বসুধারা ব্রতের উদ্দেশ্য বসুধা বা পৃথিবীকে উর্বরা এবং শস্য-সবুজ করে তোলা। ফসলের জন্য জল চাই, জলের জন্য বৃষ্টি চাই, বৃষ্টির জন্য মেঘ। বঙ্গদেশকে মেঘালয় করে তোলার কামনার নামই বসুধারা ব্রত। বসুধারা ব্রতের আলপনায় তুলসীমঞ্চের ঠাঁট সহ তুলসীগাছ আঁকা হয়। আর আঁকা হয় স্বস্তিক চিহ্ন এবং তুলসীমাতার ছবি।
পৃথিবী ব্রত
বাংলার কুমারী মেয়েরা পরপর চার বছর ধরে চৈত্র সংক্রান্তি থেকে বৈশাখ সংক্রান্তি পর্যন্ত এই ব্রত পালন করে। সংসারের যাবতীয় মঙ্গল কামনাই মূল উদ্দেশ্য, এমনকি সমগ্র পৃথিবীর মঙ্গলও। উঠোন জুড়ে অথবা মেঝেতে পিটুলি গোলা দিয়ে আঁকা হয় পদ্মের বন। তার মধ্যে আঁকা হয় ধরিত্রীমাতা বা পৃথিবী দেবী৷ পুজোর উপচার ও উপকরণগুলি মন্ত্র পড়ে তিন বারের জন্য ঢেলে দেওয়া হয় আলপনার উপর। যেন পৃথিবী শান্তি পায়, অসুখ দূর হয়, মানুষও সুখী হয়৷
অরণ্যষষ্ঠী ব্রত
জ্যৈষ্ঠ্যমাসের শুক্লা ষষ্ঠীর দিনটিতে পালিত হয় আরণ্যক জীবনাভিজ্ঞতার এক অপরূপ কৃত্য ‘অরণ্যষষ্ঠী’। দিনটি জামাইষষ্ঠী, বাঁটাষষ্ঠী বা স্কন্দষষ্ঠী নামেও অভিহিত। অরণ্যের সঙ্গে এই দিনটি সম্পৃক্ত, সম্ভবত অরণ্য-কেন্দ্রিক সভ্যতার সঙ্গে মানুষের হারানো যোগসূত্রের সাক্ষ্য-বহনকারী একটি পার্বণ। যখন অরণ্য-মাতাই ছিলেন মানুষের বেঁচে থাকার যাবতীয় রসদদার। মানুষ যে যুগ থেকে খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-ভেষজের জন্য নির্ভর করতো অরণ্যের উপর, সেই যুগের বন-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের উৎসব অরণ্যষষ্ঠী। কৃষি সভ্যতার যুগেও ছিল কৃষি-বন (Agroforestry)-এর ধারণা, বহাল ছিল অরণ্যের উপর প্রতিনিয়ত নির্ভরশীলতা। তাই যুগের পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অরণ্যষষ্ঠীর কৃত্য ক্রমে ক্রমে বদলে গেল। যে মূল রূপটি খুঁজে নিতে হয়, তা হল, সভ্যতার যতই অগ্রগতি হোক না কেন, অরণ্য ও তার বনস্পতি, তার অপরিমেয় জৈববৈচিত্র আজও আমাদের পরম আশীর্বাদ; কৃষিমাতার সঙ্গে বনদেবী আমাদের সতত রক্ষাকর্তা। ফুলে-ফলে-পল্লবে অরণ্য ভরে থাকুক আমাদের নানান প্রয়োজনে; এ তারই কৃতজ্ঞতার উপাসনা, অরণ্য-প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের অমোচ্য-সংযোগের চিরকালীন ইতিহাস।
ষষ্ঠী সর্বদা সন্তানের মঙ্গলময়ী মাতা। কেবল আপন সন্তান নয়, আপনার কন্যার স্বামীও যে তার সন্তান, এই বোধটি প্রকটিত হয়েছে জামাইষষ্ঠী নামের মধ্যে দিয়ে। ভারতীয় নারী তার পুত্র-কন্যার সমগ্র পরিবারটিকে একসূত্রে গাঁথতে চান, তার প্রকাশ ঘটেছে জামাই আদরের প্রেক্ষাপটে। গ্রীষ্মের দিনে অধিকাংশ ভারতীয় ফল পেকে ওঠে গাছের শাখায় শাখায় — আম, জাম, জামরুল, কাঁঠাল, কলা, বুনো খেজুর, ফলসা, আঁশফল, কুসুম, গাব, কেন্দু, কামরাঙ্গা পেকে উঠেছে অজস্র। এই সুখের দিনে ছেলেমেয়ের ভরা সংসার দেখতে চান হিন্দু নারী, নাতি-নাতনীদের হৈ-হুল্লোড়, গাছে গাছে দাপাদাপি। এরপর তো শুরু হবে বর্ষা, নদীনালা জলে পূর্ণ হয়ে যাতায়াত সুখের হবে না, তাছাড়া আমন মরশুমি চাষে ব্যস্ত হয়ে পড়বে সবাই। তাই ফলের মরশুমে তাদের সকলের নিমন্ত্রণ। দল বেঁধে কৃষি জমির উপান্তে জঙ্গল ঘেরা ফল বাগিচার মধ্যে কোনো এক প্রাচীন বৃক্ষের তলায় অরণ্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর পুণ্যক্ষেত্রে পূজারিণীদের সমবেত পদচারণা।
ক্রমে ক্রমে বদলে গেল। যে মূল রূপটি খুঁজে নিতে হয়, তা হল, সভ্যতার যতই অগ্রগতি হোক না কেন, অরণ্য ও তার বনস্পতি, তার অপরিমেয় জৈববৈচিত্র আজও আমাদের পরম আশীর্বাদ; কৃষিমাতার সঙ্গে বনদেবী আমাদের সতত রক্ষাকর্তা। ফুলে-ফলে-পল্লবে অরণ্য ভরে থাকুক আমাদের নানান প্রয়োজনে; এ তারই কৃতজ্ঞতার উপাসনা, অরণ্য-প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের অমোচ্য-সংযোগের চিরকালীন ইতিহাস।
ষষ্ঠী সর্বদা সন্তানের মঙ্গলময়ী মাতা। কেবল আপন সন্তান নয়, আপনার কন্যার স্বামীও যে তার সন্তান, এই বোধটি প্রকটিত হয়েছে জামাইষষ্ঠী নামের মধ্যে দিয়ে। ভারতীয় নারী তার পুত্র-কন্যার সমগ্র পরিবারটিকে একসূত্রে গাঁথতে চান, তার প্রকাশ ঘটেছে জামাই আদরের প্রেক্ষাপটে। গ্রীষ্মের দিনে অধিকাংশ ভারতীয় ফল পেকে ওঠে গাছের শাখায় শাখায় — আম, জাম, জামরুল, কাঁঠাল, কলা, বুনো খেজুর, ফলসা, আঁশফল, কুসুম, গাব, কেন্দু, কামরাঙ্গা পেকে উঠেছে অজস্র। এই সুখের দিনে ছেলেমেয়ের ভরা সংসার দেখতে চান হিন্দু নারী, নাতি-নাতনীদের হৈ-হুল্লোড়, গাছে গাছে দাপাদাপি। এরপর তো শুরু হবে বর্ষা, নদীনালা জলে পূর্ণ হয়ে যাতায়াত সুখের হবে না, তাছাড়া আমন মরশুমি চাষে ব্যস্ত হয়ে পড়বে সবাই। তাই ফলের মরশুমে তাদের সকলের নিমন্ত্রণ। দল বেঁধে কৃষি জমির উপান্তে জঙ্গল ঘেরা ফল বাগিচার মধ্যে কোনো এক প্রাচীন বৃক্ষের তলায় অরণ্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর পুণ্যক্ষেত্রে পূজারিণীদের সমবেত পদচারণা।
এদিন ব্রতচারিণী হিন্দু রমণী তালপাতার এক পাখা বা ব্যজন, সঙ্গে দেবীপূজার নানান উপকরণ নিয়ে বনে প্রবেশ করেন। সেখানে বৃক্ষতলে অধিষ্ঠিত বিন্ধ্যবাসিনী অরণ্যষষ্ঠী দেবীকে আন্তরিক ভক্তিশ্রদ্ধায় পুজো করেন, সমবেতভাবে দেবীর উপাখ্যান শোনেন, তারপর নানাবিধ মরশুমি ফলমূল পরিবার ও আত্মীয়স্বজনকে বিতরণ করে নিজেরাও গ্রহণ করেন। সন্তানসন্ততির পরম কল্যাণ কামনাই এই ব্রতের মূলকথা। বৃহত্তর অর্থে মনুষ্য সমাজ সবাই যে অরণ্যের সন্তান। কামনা এই — দেবী অরণ্য, তুমি যাবতীয় সম্পদ ভরিয়ে দিয়ে আমাদের ঐশ্বর্যশালী করে তোলো। অরণ্যের পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করে আমরা পরিপুষ্ট হই এবং সুসন্তান লাভ করি, তোমাকে দোহন করেই আমরা সন্তানেরা দীর্ঘায়ূ হই, ধনেজনে পরিপূর্ণ হয়ে উঠুক জনপদ। তাই অরণ্যষষ্ঠী অরণ্যের উপান্তে গড়ে ওঠা জানপদিক লোকসংস্কৃতির এক অমূল্য সাধনা। অরণ্যেই ছড়িয়ে পড়ত গৃহীত ফলের বীজের প্রাচুর্য; তারপরেই আসতো বর্ষার ধারা, বীজের সুপ্তি কেটে চারাগাছ বেড়ে উঠতো আপন মনেই। অরণ্যের মাঝে ফলাহারের এ এক দারুণ উৎসব, অরণ্যকেই বর্ধিষ্ণু করে তুলতো। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’ উপন্যাসের জঙ্গলবন্ধু যুগলপ্রসাদকে দেখি জঙ্গলের মধ্যেই সে বনস্পতির চারা লাগান, জঙ্গলেই বনসৃজন করেন। এ যে তেলা মাথায় তেল দেওয়া নয়! জঙ্গল কেটে ক্রমাগত বসতি স্থাপন করে, চাষাবাদ করে আমরা বনের রুখাশুখা মাটিকে নগ্ন করে দিয়েছি। বাদাবন কেটে ঝড়-ঝঞ্ঝার অবারিত দ্বার খুলে দিয়েছি। অরণ্য যে কেবল কেটে নেবার জিনিস নয়, লুঠপাটের ক্ষেত্র নয়, তা ভারতীয় জীবনবোধ চিরকালই দেখিয়ে এসেছে, বিদেশি কলোনিয়াল ও অন্যান্য লুঠেরা শক্তিই ভারতবাসীকে অরণ্য লুঠপাট করতে শিখিয়েছে। অথচ প্রাচীন সাহিত্যে অরণ্যকে বলা হয়েছে ‘দেবতার কাব্য’।
ষষ্ঠী দেবীর বাহন একটি কালো বেড়াল। বাহন কল্পনার মধ্যে ফার্টিলিটি-কাল্ট বা প্রজনন-সংস্কৃতিকে মান্যতা দেওয়া হয়েছে। বেড়ালের বংশবিস্তার সম্পর্কে মানুষ সচেতন। এই দিন বেড়ালকে ভালোমন্দ খেতে দেবার মধ্যে জীবসেবার আদর্শকে ব্রতের আঙ্গিকে প্রোথিত করে দেওয়া হয়েছে।
কাসুন্দি-তৃতীয়া
অক্ষয় তৃতীয়ার দিন কাসুন্দি তৈরি হওয়ার রেওয়াজ আছে। তাই একে কাসুন্দি-তৃতীয়া বলে। সেদিন নেতৃত্ব দিতেন ঠাকুমা-দিদিমারা। বাড়ির সব মহিলাদের মধ্যে সাজো সাজো রব। আগের দিন উঠোন, ঘর গৃহস্থালি পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখা হয়। উঠোন গোবর জল দিয়ে ঝাঁটিয়ে রাখা হয়। কেনা হয় কয়েক কেজি বড় কালো দানার সুপুষ্ট সরষে। ওইদিন সকালে পরিস্কার কাপড়ে সরষে ঢেলে তাতে ধান দূর্বা, গোটা হলুদ দিয়ে স্ত্রী আচার পালন করে নেন ঠাকুমা-দিদিমারা। কাসুন্দি করবার ‘আইস্য’ সকলের থাকতো না। এ লোকসংস্কৃতিগত এক বিশেষ অধিকার। সবাই কাসুন্দি করতে পারেন না। সেরকম আমসত্ত্ব, আচার, চাটনি করার কাজেও ‘আইস্য’ থাকতে হয়। গ্রামে এক একজনের থাকতেন, পল্লীঘরে তাদের ডাক পড়তো সেদিন। এসব মেয়েলি লোকাচারের ব্যাপার, এরমধ্যে ধর্মের ব্যাপার ছিল না।
সকল এয়োস্ত্রীরা এদিন সকালে দলবেঁধে যান পুকুর, নদীতে। সমবেত ভাবে স্নান করেন, তারপর কোমর জলে দাঁড়িয়ে কাপড়ের মধ্যে কচলে ধুয়ে নেন সরষে দানা। পিতলের কলসী করে অ-ঘোলা জল ভরে নিয়ে আনেন। তারপর কাপড়ে বিছিয়ে সরষে শুকিয়ে নেওয়া হয়। সরষে শুকোলে হামান দিস্তায় তা গুঁড়িয়ে নিতে হয়। উঠোনে পড়ে মাটির উনুন। আম-কাঁঠালের শুকনো কাঠ জোগাড় করে রাখতে হয়। কাঠের উনুনে পুকুরের জল ফোটে। হাড়ির জল আর্ধেক ফুটে এলে সরষে গুঁড়ো পরিমাণ মতো ফুটন্ত জলে আলতো করে ঢেলে দেন ঠাকুমা/দিদিমা। পরিমাণ মতো লবণ। তার আগে দেওয়া হয় খোসা ছাড়ানো কাঁচা আম বাটা। তারপর মাটির ঢাকনা দিয়ে হাড়ির মুখ ঢেকে ঘরে তোলেন ঠাকুমা। মা-কাকিমারা সবাই শঙ্খধ্বনি আর উলুধ্বনি দেন পিছনে পিছনে। এইভাবে কয়েক হাড়ি কাসুন্দি নামে। সব আয়োজন শেষ হতে বিকেল গড়িয়ে যায়।
কাসুন্দি গড়ে মায়েরা অস্তগামী সূর্যের লাল আভায় তাকিয়ে অনেক মন্ত্রোচ্চারণ করেন — কিছুটা শাস্ত্রীয়, কিছুটা লৌকিক। মোদ্দা কথা হল — হে সূর্যের শক্তি, তোমার সৌকর্যে প্রস্তুত এই কাসুন্দি চমৎকার হোক, দুষ্ট অণুজীবের বাসা-বর্জিত হোক কাসুন্দি, তার গুণগত মান বজায় থাকুক, ঝাঁঝ পরিপূর্ণ ভাবে বজায় থাকুক, আগামী এক বছর তা গৃহের পরিবেশে সংরক্ষিত থাকুক, রঙ-ঔজ্জ্বল্য বজায় থাকুক। ঠাকুমা-মা-কাকিমারা প্রত্যেকে সেদিন লাল পাড় সাদা শাড়ি পড়ে অনাড়ম্বরভাবে সাজেন। এরপর আরও কয়েকদিন হাঁড়ি গুলি সারা দিন রোদ খাওয়ানো হয় পরিচ্ছন্ন পোষাকে। তারপর সেই কাসুন্দি হাঁড়ি থেকে শিশি-বোতলে তুলে রাখা হয়। ভালো কাসুন্দ খানিকটা তিতকুটে আর খুবই ঝাঁঝালো হয়। বাড়িতে পাটের তন্তু দিয়ে তৈরি সিকের উপর কাসুন্দির হাঁড়ি ঝুলিয়ে রাখা হয় কোনো কোনো বাড়িতে। মায়েরা সন্ধ্যারতির সময় ওখানেও ধূপদীপ দেখান।
দশহরা
জৈষ্ঠ্যের শুক্লা দশমীতে গঙ্গা হন ‘দশহরা’। দশহরার দিন দশ জন্মার্জিত দশবিধ পাপ বিনষ্টির জন্য গঙ্গাস্নান করতে হয়। পৌরাণিক বার্তায় রয়েছে দশহরার দিনে প্রাণদায়িনী গঙ্গা মর্ত্যে অবতরণ করলেন এবং ধরিত্রীবাসীর অশেষ কল্যাণ সাধনা করলেন৷ এক বিস্তীর্ণ অববাহিকায় ফলে উঠলো সবুজশস্য, গড়ে উঠলো ঐশী সভ্যতা। সেই গঙ্গা কে? তিনি কোথা থেকেই বা এলেন? আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু লিখছেন, নদীকে জিজ্ঞাসা করিতাম “তুমি কোথা হইতে আসিতেছ?” নদী উত্তর করিত “মহাদেবের জটা হইতে।” তখন ভগীরথের গঙ্গা আনয়ন বৃত্তান্ত স্মৃতিপথে উদিত হইত।
অলকানন্দা হল স্বর্গের গঙ্গা। স্বর্গীয় প্রাণশক্তিকে মর্ত্যে বজায় রাখবে গঙ্গার প্রবাহ। তাই স্বর্গ থেকে অলকানন্দা ভেসে এসে মর্ত্যে মন্দাকিনীতে মিলিত হচ্ছে। এটা মিথ-পুরাণ। সমভূমিতে এসে তার প্রাণপ্রবাহ। ফসল ফলাতে চান দেবী, বিশ্বগ্রাসী ক্ষুধাকে নিবৃত্ত করতে চান। কৃষি সম্প্রসারণের ‘ভগীরথ’ হলেন কৃষিবিদ, যিনি শিবের জটাজালের মতো থাকা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রযুক্তি মুক্ত করে দেবেন মর্ত্যের কৃষকসমাজকে। পার্থিব দৃষ্টিতে ভগীরথ চিরকালীই সম্প্রসারণবিদ।
করমপূজা
অরণ্যের মাঝে পাতাঝরা বৃক্ষ, করম গাছের সারি; তাতে অধিষ্ঠান করে আছেন করমদেবতা। তাঁরই সামীপ্যে সান্নিধ্যে পৌঁছে গিয়ে প্রকৃতি মায়ের আঁচলে বাঁধা থেকে একদল মানুষ আয়োজন করেছেন এক পার্বণের। ভাদ্রের শুক্লা একাদশী, মাঝ-শরতের মানানসই দিন; অরণ্যের উপান্তে আউশধান কাটা হয়ে গেছে। তখনই অরণ্য-সংস্কৃতির মাঝে হলদু-বৃক্ষের তলায় বর্ষার মেঘমেদুরতায় দেবতার থানে শিকড়ের সন্ধানে ছুটে এসেছে বনবাসী মানুষের বোধ। মনে হয় যেন দেবতার কাব্য করমপাতার সবুজের অরণ্যে এভাবেই বুঝি চিরকাল লেখা হয়ে থাকে, সেই আদি অনন্ত যুগ ধরেই তার কাব্য-সুষমা। লেখা হয় লোককবির কলমেও —
“ভাদর মাসে করমপরব
মুদের ঘরে ঘরে
বাঁজা মাটি গাভিন হবেক
বীজের ফোড়্যেফোড়্যে
দাঁতন কাঠি বাঁশের টুপা
বালি ভরা ডালা
ডালা ঘিরে বিটিছিল্যার
জাওয়া গানের পালা।”

যখন ভাদ্ররাতের শুক্লা একাদশীর ভিজে চাঁদ আকাশের মেঘ অনবধানে ফাঁক হয়ে বিরল হয়ে দেখা দেবে জঙ্গলমহল, ঝাড়খণ্ড, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিসগড় জুড়ে লোকবাদ্যের তালে তালে সাঁওতাল, মুন্ডা, ওরাওঁ সমাজের আনন্দ-উৎসবে, তখন অনাবিল আনন্দ, আনন্দ জোলো মেঘের কোণেও, যেন অংশ নিতে চায় প্রকৃতি পূজায়। তাতে কুড়মি, ভূমিজ, লোহার, বাউড়ি, বীরহোড়, খেরওয়ার, হো, খেড়িয়া, শবর, মাহালি, পাহাড়িয়া জনজাতিরও অংশগ্রহণ। প্রকৃতি মাতার কোলে ফিরে ফিরে আসে সমাজের নিবিড় নাড়ির টান। আনন্দ যৌবনের দেবতা করম, তাঁর আহ্বানে অরণ্যচারী মানুষ কৃষিকাজের মাঝে আনন্দে মেতে ওঠার ফুরসৎ পায়। করম ঠাকুরের অমল আশীর্বাদে প্রকৃতির মাঝে অফুরন্ত ফসল ফলে উঠবে যেন! বিশ্বব্যাপী ক্ষুধার আহার্য সংগ্রহের শক্তি যোগানের ব্যবস্থা করবেন তিনি — এ যেন তারই ভরসা-পার্বণ। কুড়মি সমাজ আনন্দে গেয়ে উঠবে —
“আমরা যে কুড়মি জাতি
করম লাগি সারা রাতি
আমরা গো করমপূজা করি এক মনে
ভাদর মাসের একাদশীর দিনে।“

যে গাছকে কেন্দ্র করে করমপূজা এবার তার পরিচয়ে যাই। জনজাতি সমাজে গাছটির পরিচিতি ‘করম’ নামে; বাংলায় এর নাম কেলী-কদম। সংস্কৃত সাহিত্যে নাম পাওয়া যাচ্ছে ‘গিরিকদম্ব’, অর্থাৎ ভারতের মালভূমির অনুচ্চ পাহাড়ে পাহাড়ে ফুটে ওঠা কদমেরই দূরবর্তী জাতভাই। অসমিয়া ভাষায় গাছের পরিচয় ‘তারকচাঁপা’, ফুলের হলুদ রঙের জন্য কেউ আদর করে ডাকেন ‘হলদু’। ইংরেজি নাম Yellow Teak বা হলুদ সেগুন; কিংবা Saffron Teak ব গেরুয়া সেগুন। রুবিয়েসী গোত্রের (কফিগাছ যে গোত্রের গাছ) গাছটির বিজ্ঞানসম্মত নাম Adina cordifolia (Roxb.) Hook. f. Ex Brandis. গাছটি Haldina cordifolia (Roxb.) Ridsdale নামেও লিপিবদ্ধ আছে বোটানির পাঠ্যপুস্তকে৷ প্রায় ২০ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট এই বৃক্ষ জাতীয় গাছ, জুন থেকে আগষ্ট – ফুটতে থাকে সুন্দর ফুল। এই গাছটি ভারতের পর্ণমোচী অরণ্যের একটি অনন্য সম্পদ; দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সম্ভবত এই গাছটির আদিনিবাস। ভারত ছাড়াও মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, নেপাল, ভূটান, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ চীন, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়াতে এই গাছের বিস্তারণ চোখে পড়ার মতো। গাছের ছালের রঙ হাল্কা বাদামী, ছালে অগভীর এবড়োখেবড়ো, অসমান জমিন। ১০০০ থেকে ২০০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত এবং ২৫ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এই গাছের বাড়বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয়; সামান্য অম্লত্ব মাটিতে থাকা পছন্দ করে এই গাছ। গাছটির নানান ভেষজগুণ জনজাতি সমাজে তা আদরণীয় করে তুলেছে।
করমপূজায় এই করম গাছের তলায় পূজা ও আনন্দগীতি সুসম্পন্ন হবে। যদি গাছ না থাকে তবে তার ডাল পবিত্রমনে তুলে আনতে হবে, সাত্ত্বিকভাবে সংগ্রহ করে লাগিয়ে দিতে হবে মাটিতে, তাকে কেন্দ্র করেই করমপূজা সম্পন্ন হবে। করমগাছের সতেজ নরম-কাণ্ডের কাটা কলমে (Softwood cutting) ৪০০০-৬০০০ পিপিএম IBA হর্মোন পাউডার ব্যবহার করে শিকড় উৎপাদন সম্ভব বলে জানা গেছে। করমপূজায় ডাল কেটে বসানোর মধ্যে হয়তো হাজার হাজার বছরের কলম করার ঐতিহ্য লুকিয়ে আছে। গাছের অঙ্গজ কলম করার কৌশল হয়তো বনবাসী জনজাতি সমাজে প্রচলিত ছিলই। উৎসবের আচারের মধ্যে তার মিসিং লিঙ্ক আজ ধরা পড়ছে। করমপূজার সঙ্গে অপরিহার্য কৃত্য হল ‘জাওয়া পরব’। এই অনুষ্ঠানে বিবিধ ফসলের বীজ অঙ্কুরিত করে নেওয়া হয় বাঁশের বা মাটির ডালার মধ্যে; তাকে ঘিরে নাচগান সম্পন্ন হবে। এই অনুষ্ঠানের মধ্যে Seed Germination বা বীজের অঙ্কুরোদগমের পরীক্ষার ধারণাটি লুকিয়ে আছে। যদি উত্তম মানের অঙ্কুরিত চারা ডালায় ডালায় ভরা থাকে, তবে অনুমান করা যায়, মাঠে সেই বীজ বুনলে বেশি সংখ্যক চারাই বেরোবে এবং ফলনও হবে বেশি। অতএব করমপূজা কেবল প্রকৃতি কেন্দ্রিক উৎসব নয়, তা সমৃদ্ধ কৃষি সংস্কৃতির চেনা লুপ্ত ইতিহাস। চেনার মাঝে অচিনকে আবিষ্কার করার চিহ্ন সংকেত রয়েছে করমপূজার আনন্দ-পার্বণের পরতে পরতে।
আশ্বিন সংক্রান্তি
আশ্বিন সংক্রান্তিকে বাংলার লোকায়ত জীবনে ‘ডাক সংক্রান্তি’-ও বলে, কারণ এইদিনে আমনধানকে বিশেষভাবে ডাকা হয়, ফলন প্রার্থনা করা হয়। এদিনেই ধান্যলক্ষ্মীর সাধ-ভক্ষণ অনুষ্ঠান। পালিত হয় গারসিপূজার ব্রত। ব্রতের অঙ্গ হিসাবে খেসারির ডাল খাওয়া হয়। খেসারির বীজ ধানজমির আর্দ্রতায় ছড়িয়ে দিয়ে সাথী ফসল নেওয়া হয়। সবমিলিয়ে গারসিব্রত, ধানডাকা এবং নলপুজোয় জমজমাট বাংলা।
বাংলার লোকায়ত জীবনে সংক্রান্তিগুলি নানান আচার পালনের মধ্যে দিয়ে, পূজাপার্বণ-ব্রত উৎযাপনের মধ্যে দিয়ে, সংস্কৃতির পরত মাখিয়ে শিকড়ের অনুসন্ধানে অনবধানে আমাদের কখন যেন পৌঁছে দিয়েছে৷ নানান বিধিনিষেধ মানার মধ্যে দিয়ে আমরা মরশুমি তাপমাত্রা, আপেক্ষিক আর্দ্রতা, সূর্যালোক, বায়ুপ্রবাহ প্রভৃতির সঙ্গে নিজেদের শরীরকে খাপখাইয়ে নিতে পারি। রানী চন্দ লিখছেন (“আমার মা’র বাপের বাড়ি” গ্রন্থে), আশ্বিনের সংক্রান্তি — ধীর শান্ত। শীতল জিনিস খাও, শীতল হয়ে থাকো। হেমন্তের কালটা ভালো নয়। হাওয়া, ‘ওম’ ভারী — এ কথা শুরুতেই মনে রাখতে হয়। মামীরা আশ্বিন সংক্রান্তিতে ভাত রান্না করে জল ঢেলে রাখেন, পরদিন ভিজে ভাত খান। বলেন — ‘আশ্বিনের ভাত কার্তিকে খায়, যেই বর মাগে সেই বড় পায়।’
সংক্রান্তির দিন বাইরে থাকার নিয়ম কেন নেই? কেন সংক্রান্তির আগে আত্মীয়স্বজনের বাড়ি থেকে ফিরে আসতে হয়? কারণ গৃহ পরিবেশে পরিবারের সকলকে সঙ্গে নিয়ে ঘরোয়া মেজাজে আনন্দ উৎসবে সামিল হন সকলে। এই অসামান্য লোকচারণাগুলির মধ্যে বাংলার সংক্রান্তিগুলি সম্পৃক্ত হয়ে রয়েছে। আশ্বিন সংক্রান্তির সময় বাংলায় দুর্গাপূজার আবহ — কোনো বছর দুর্গাপুজো শুরু হবে, কোনো বছর কালীপুজো আসবে। এই সময় আউশধান দিয়ে কৃষকের গোলাখানি ভরা। আমন ধানে তখন লক্ষ্মী গর্ভে বসেছেন। ধানের শীষ আসার আগে গাছের ডগ ফুলে উঠেছে আনন্দে, যেন পোয়াতি মা। এই দিনটিকে বাংলায় ‘নল সংক্রান্তি’ বলে। নলপুজো হয় ধানের জমিতে।
নলপুজো হল গর্ভিণী ধানের সাধভক্ষণ উৎসব। শালিধান অর্থাৎ আমন ধান মাঠে মাঠে ঢেউ খেলে চলেছে। আসছে ধানের ফুল, পরাগমিলন হবে, তারপর দানা। সমগ্র প্রক্রিয়াটি যেন পোয়াতি মায়ের সন্তান ধারণের মতই ব্যাপার।
ধানের সাধ দেওয়া হয় আশ্বিন সংক্রান্তিতে। যখন ফুল আসার আগে পোয়াতি মায়ের মতই ধানের ডগা ফুলে ওঠে। ধান্যলক্ষ্মীর সাধ কৃষিজীবী মানুষের আবহমানকালের আচার। কোন প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে চলে আসছে কেউ জানেন না। এই উৎসব আসলে ‘পৃথিবী পুজো’ (Earth Worship)। আদিম মানুষ বুঝেছিল, সন্তান আর ফসল দুই-ই উৎপাদন। সন্তান ধারণ করেন মা, আর ফসল ধারণ করে মাটি, সুতরাং ফসল নিয়ে আবির্ভূতা পৃথিবী বা মাটি মাতৃদেবী।
ধানকে সাধ দেওয়া একটি অনুকরণাত্মক যাদু বা Imitative Magic. যা করবো বাস্তবে তাই হবে। ধানের শিষ আসার আগে ধানের ডগাটি পোয়াতি মায়ের পেট। ফুলে ওঠা এই পেটকে বলে ধানের ‘থোড় দশা’ বা Booting stage. এটিই হল ধানের গর্ভসঞ্চার। নল-খাগড়ার জঙ্গলে যেমন অসামান্য বংশবিস্তার! নল-খাগড়া যেমন ঝাড়ে জঙ্গলে বেড়ে ওঠে! তাই নলগাছের অবয়বে প্রভূত প্রজনন শক্তি বিরাজ করে, এটাই লোক-সমাজের বিশ্বাস। বিশ্বাস, ধানক্ষেতে নলপুজো করলে নলের প্রবণতা ধান-ফসলেও সঞ্চারিত হবে। তাতে প্রচুর ধান ফলবে। নৃতত্ত্ববিদ্যার ভাষায় একেই বলে Imitative magic বা অনুকরণাত্মক যাদু প্রক্রিয়া। বাংলার নানান অঞ্চলে নল সংক্রান্তি পালিত হয়। রাঢ় ও দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্ত বাংলায় নল পুজোর আগের দিন সশিষ নল গাছ কেটে আনা হয়। তাতে নানান বনৌষধি ও লৌকিক সামগ্রী বোয়াল পাতায় মুড়ে নলগাছের পাতায় বাঁধা হয়। বুনো ওল, কেশুতের শেকড়, রাই সরষে, হলুদ, নিম, শুকতো পাতা এবং চালের খুঁদ থাকে সামগ্রীর তালিকায়। কৃষক নলের গোড়া ধুয়ে শালুক ফুলে জড়িয়ে ধান-ক্ষেতে নিয়ে যায় নল পুজো করতে।
বাংলার কোনো কোনো জায়গায় আশ্বিন সংক্রান্তিতে ‘ধান-ডাকা’ নামক লোকানুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। এটি শস্যদেবীকে সন্তুষ্ট করার একটি আচার। প্রভূত ধান উৎপাদনই হবে — এটাই কামনা। কৃষকে কৃষকে উন্নত চাষের রেষারেষি এই উৎসবে ধরা পড়ে। লৌকিক ছড়ায় পাচ্ছি — “লোকের ধান হুলুসথুল/ আমার ধান শুধুই ফুল/ ধান — ফুল ফুল ফুল।” কোথাও ছড়া কাটা হয়, “অন-সরিষা, কাঁকুড় নাড়ি,/যা-রে পোক ধানকে ছাড়ি/এতে আছে শুকতা,/ধান ফলবে গজ মুক্তা।/এতে আছে কেঁউ,/ধান হবে সাত বেঁউ।”
কোথাও আশ্বিন সংক্রান্তিতে বানানো হয় ‘ভালাভুলা’। রানী চন্দের বর্ণনা আছে, “বাঁশের মাথায় খড় দড়ি দিয়ে মানুষের মতো একটা গোল মাথা — দু দিকে দুটো হাত বানিয়ে ভালাভুলা বাঁধো। ভিতরে দেয় মশা মাছি আর ইচা-খৈল্সা মাছ।” এদিন সব বাড়ির গৃহস্থ ভালাভুলা জ্বালিয়ে হাতে নিয়ে বাড়ির চারপাশে ঘোরেন আর বলেন, “মশা মাছি দূর হ — সাপ ব্যাঙ দূর হ — ভুল-ভাল দূর হ।…..ইচার কাড়া বৈচার মুড়া, ভুল গেল রে উত্তর মুড়া।” এইসব ছড়া বলে গৃহস্থ উত্তর দিকে ছুঁড়ে দেয় ‘ভালাভুলা’। গৃহ পরিবেশ থেকে যাবতীয় মশা মাছি সাপ ব্যাঙ এবং সেই সঙ্গে সাংসারিক ভুলভ্রান্তি গৃহস্থের আঙিনা থেকে দূর করে দেবার একটি ম্যাজিক যেন! এই পোড়ানো জিনিস থেকে যে ধোঁয়া উৎপন্ন হয়, তাতে মশা-মাছি পালায়। বাস্তবে এইসময় ডেঙ্গুর মশা ও ডেঙ্গুজ্বরের আক্রমণ প্রবল হয়। হয়তো লোকায়তিক সংস্কৃতিতে ডেঙ্গুর মশা এইভাবেই দূর করা হত।
আশ্বিন সংক্রান্তির দিনে পালিত হয় ‘গারসিব্রত’। এটি লক্ষ্মীব্রতের অন্যতর রূপ। অনেক জায়গায় ‘গারু সংক্রান্তি’ বা ‘গাস্বীব্রত’-ও বলে থাকেন লোকসমাজ। এই কৃষি আচারে লক্ষ্মীদেবীকে তাল মিছরি এবং ভেজানো খেসারির নৈবেদ্য দেওয়া হয়। ব্রতিনীরা উপবাস ভঙ্গ করেন ভেজানো বা রান্না করা খেসারির ডাল খেয়ে। হাল অথবা জাল ব্যবহার করে পাওয়া কোনো খাবার এদিন খেতে নেই। বছরের এই একটি দিন। ধান থেকে শুরু করে প্রায় সকল ফসল পেতে হয় জমিতে হাল দিয়ে বা লাঙ্গল দিয়ে। মাছ, কাঁকড়া প্রভৃতিও জাল দিয়ে ধরতে হয়। যেহেতু খেসারি চাষ করতে আলাদা করে কোনো হালের ব্যবহার হয় না, ‘পয়রা ক্রপ’ হিসাবে ধানের জমিতে ধান কাটার একমাস আগে ভেজা মাটিতে খেসারির বীজ ছড়িয়ে দেওয়া হয় এবং মূল ধান কাটার প্রায় দুমাস পর একরকম বিনা কর্ষণে ফসল কেটে নেওয়া হয়। একেই কৃষির পরিভাষায় ‘পয়রা ফসল’ বলে। বাংলার লোকসংস্কৃতি চর্যায় খেসারির ডালের পর্যাপ্ত ব্যবহার রয়েছে। অথচ এই ডাল কাঁচা বা রান্না করে খেলে স্নায়বিক পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে। তাই কৃষিবিজ্ঞানীরা এই ডালের নার্ভ-টক্সিন দূর করতে সচেষ্ট হয়েছেন; বাংলার গবেষকদের দ্বারা উদ্ভাবিত ‘নির্মল’ জাতটি এই দোষ থেকে মুক্ত।
খুব ভোরে উঠে এদিন রান্না করতে হয় খেসারির ডাল; তারসঙ্গে হাল ব্যবহার না করে জন্মানো শাক সবজি সেদ্ধ দেওয়া হয়, যেমন মানকচু, দুধকচু, কৃষ্ণকচু, ওল। এই বিশেষ ডাল রান্নাকে বলে ‘আসমবারি’। এই ডালে হলুদ এবং তেল-মসলার ব্যবহার পুরোপুরি নিষিদ্ধ।
দেবী লক্ষ্মীকে সন্তুষ্ট করতে ঘর ও উঠোন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হয়। ব্রতিনীরা গারসির ব্রতকথা শোনেন পুজোর পর। বাড়ির মেয়ে-বউরা এই ব্রত করে থাকেন। কৃষি-কামনাই এই ব্রতের মূল উদ্দেশ্য। এই দিনে তাড়ানো হয় অলক্ষ্মীকে, বোধন করা হয় দেবী লক্ষ্মীর।
কার্তিক সংক্রান্তি
কার্তিক ব্রতের প্রধান অঙ্গ কার্তিকের প্রতিমা পুজো। সায়ংকালে শুরু হয় পুজো — চার প্রহরে চারবার পুজো আর কথা শ্রবণ; অশক্ত হলে একবারই পুজো এবং প্রাতঃকালে বিসর্জন, যদিও পূর্ববঙ্গে প্রতিমা জলে দেওয়ার নিয়ম নেই।
লোকসমাজে কার্তিক শস্য দেবতাদের অন্যতম। কার্তিক সংক্রান্তিতে উত্তরবঙ্গ ও সন্নিহিত বাংলাদেশে শস্যদেবতা কার্তিককে পুজো করা হয়, কাটোয়া মহকুমায় পরে তিনিই (নবানে কার্তিক) পূজিত হন নবান্ন-এর উৎসবে। কার্তিক সংক্রান্তিতে গাওয়া হয় ফসল-সুরক্ষার গান — “কাল না ছেলেটায় ডাক দিয়া কইয়া যায়/বাদুড় পড়িছে খেতে/আরে রে বাবুইরে/খেতের পাকে ধান না খাইলে।” বাংলার অনেক অঞ্চলে কার্তিক পূজায় সারারাত ধরে গাওয়া হয় গান। ফসলের কীটশত্রু, জীবজন্তু তাড়িয়ে দেওয়াই গানের মূল বিষয়। পুজোর পর মূর্তিটি বিসর্জন না দিয়ে শস্যক্ষেত্রে রেখে দেওয়া হয় শস্য রক্ষাকর্তা হিসাবে। কার্তিক ব্রতে কার্তিক প্রতিমার পাশে রাখা হয় ‘হালা’। হালা হচ্ছে মাটির সরায় মাটিতে লাগানো নানান শস্য চারা। সম্ভবত কার্তিক কৃষি দেবতা বলেই এই সরার শস্যক্ষেত্র। অনেক সময় উঠোনে মন্ডল করে তার চারপাশে চারা তৈরি করেও মাঝখানে কার্তিক প্রতিমা রাখা হয়। পুজোর ঘট ছাড়াও প্রতিমার সামনে কতকগুলো ছোটো ঘট রেখে তাতে চাল ও ফল দেওয়া হয়।
ইতু/ইবতি এবং চুঙী ব্রত
কার্তিক থেকে অঘ্রান সংক্রান্তি পর্যন্ত হৈমন্তি ধান মাড়াই ও ঝাড়াই-এর শুভপর্বে উৎযাপিত হয় ইতুলক্ষ্মী ব্রত। ইতু পুজো হল সূর্যপূজা। সূর্যবাচক ‘মিত্র’ শব্দ থেকে ইতু বা ইথু শব্দের উৎপত্তি। সূর্য দেবতা কখন যে লৌকিক বিবর্তনে হয়ে উঠেছেন ধানকেন্দ্রিক শস্য দেবতা ইতুলক্ষ্মী, তার ইতিহাস অধরাই থেকে যায়। রবিবার ইতুর সাপ্তাহিক পুজো। এরই মধ্যে উৎযাপিত হয় নবান্ন; ইতু উৎযাপনের একেবারে শেষ পর্বে নিবেদিত হয় নতুন চালের পিঠে, মুঠপিঠে আর পরমান্ন; আর বাংলার কোথাও কোথাও এরই নাম ‘সাধ’।
মানভূম অঞ্চলে ‘ইবতি’-র প্রতিষ্ঠা হয় মাটির হাঁড়ি চকখড়িতে অনুরঞ্জিত করে এবং তাতে নানান গাছগাছালি দিয়ে। অন্যান্য অঞ্চলে ইতু-ঘট পাতার সময় মাটির সরা ব্যবহৃত হয়; তার উপর ছড়ানো হয় পাঁচ কড়াই (সাধারণ ভাবে চার রকমের ডালশস্য — ছোলা, মটর, মাষ কলাই, মুগ এবং যব)।
পূর্ববঙ্গে পালিত হয় চুঙীর ব্রত, কার্তিক সংক্রান্তিতে তার শুরু, অঘ্রাণ মাসের প্রতি রবিবার পালন এবং অঘ্রাণ সংক্রান্তিতে সমাপ্তি। চুঙীর ব্রতে নলগাছের চোঙার মধ্যে একুশ গাছি দূর্বা ও একুশটি আলোচাল ভরে তা দুধে স্নান করিয়ে সূর্যকে নিবেদন করা হয়। শোনা হয় ব্রতকথা।
পয়লা অঘ্রাণ
অঘ্রাণের পয়লা মানেই শালিধান্যের ক্ষেত্র-উৎসব। আগের দিন কার্তিক সংক্রান্তিতে নবান্নের দেবতা ‘নবানে কার্তিক’-এর পূজা-আরাধনা হয়ে গেছে। মাঠে মাঠে সোনালি ফসল তখন ধান্যলক্ষ্মী হয়ে ভূমিলক্ষ্মীর পদতলে ধরা দিয়েছে। এবার ‘আকবোল ধান’ (যে ধান আগে থেকেই লক্ষ্মীপূজার জন্য নিবেদিত হবার জন্য ঘোষিত) ‘মুঠ’ করে গোছ সমেত কেটে গৃহে আনার দিন। চাষীর ভাষায় ‘মুঠ আনা’। শ্রমজীবী মানুষের কাজে যেন ধরণীর ‘নজরানা’! গ্রামের গৃহস্থ পুরুষ এদিন মাথায় করে লক্ষ্মীকে ঘরে আনবেন।
গৃহস্থ তাই ভোরের স্নান সেরে নব বস্ত্র পরিধান করেছেন৷ হাতে কাস্তে, মাথায় গামছার উষ্ণীষ, কোমরেও গামছা, খালি পা। ঈশাণ কোণে গিয়ে তিনি আড়াই আলুই ধান কেটেছেন আড়াই প্যাঁচে তা পরম যত্নে বেঁধেছেন, “মাগো, তোমার কৃপা যেন জন্ম জন্মান্তরে পাই। সন্তানকে দুধে-ভাতে রাখার ভাত দিও মা। মাগো, অন্নলক্ষ্মী।” তার আগে কার্তিক অমাবস্যায় বাঁধনা পরবে গো-বন্দনা অনুষ্ঠানে গো-মাতার আশীর্বাদ নিয়েছেন চাষী, সন্তানের মুখে দুধের যোগান হোক। গোয়ালঘরে বখনা বাছুর আসুক।
‘মুঠ-ধান’ মাথায় নিয়ে গৃহে এসেছেন কৃষক। এ দেবতার আশিস। গৃহে লক্ষ্মীর আসন, উঠোনে-গোলাঘরে শস্যরূপা দেবী। আজও কলাবউ সেজে উঠেছেন। আটনে-উঠোনে-মরাইয়ে আজ মাঙ্গলিক পূজা। ময়মনসিংহগীতিকার কথা মনে হচ্ছে
“পাঞ্চগাছি বাতার ডুগুল
হাতেতে লইয়া।
ধানের গাড়ি মাঠ থেকে ঘরমুখো
মাঠের মাঝে যায় বিনোদ
বারোমাস্যা গাহিয়া।।”

এইবেলা পয়লা অঘ্রাণ থেকে শুরু হল ধান কাটার অনুষ্ঠান। এদিন থেকে কৃষকের ব্যস্ততা। নতুন ফসল উঠবে। একসময় ‘অগ্রে’ থাকা বাৎসরিক সময় মানেই ‘অগ্রহায়ণ’ বলে বিবেচ্য হত। অঘ্রাণেই শুরু পঞ্জিকার গণনা। বছরও শুরু, ধানও গোলায় আসছে।
ধান তো শুধু আমাদের আহার নয়, ধান আমাদের লোকায়তিক সংস্কৃতির ভিত্তিভূমি। গোলায় ধান ভরে উঠলেই গলায় গান আসে! অর্থনীতির পুরোটাই তখন ধানকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হত। সে আমন ধান, সেটাই শালিধন্য। আষাঢ়ে শুরু, আর কার্তিকে শেষ। এরপর ধানকাটা সারা হলে মাঠ বিষণ্ণ বিধবা।
দিকে দিকে মুনিশের হাঁকডাক আর মেসিনের ঘর্ঘর শব্দ। ধান উঠে জমি খালাস হবার অঘ্রাণ মাস এলো। সকাল থেকে সন্ধ্যে, মাঠের দেবতার সংস্পর্শে হাত পবিত্র হয়ে ওঠে কৃষি মজদুরের। মা লক্ষ্মী আশীর্বাদ করেন তাদেরও, শ্রমের বিনিময়ে আহারের সংস্থান হোক তাদের। তাই জুতো পায়ে জমিতে নয়, ভূমি স্পর্শ করে, মাথায় ঠেকিয়ে ভূমিকে ঢোকা। মোদের ধানই মোদের মান।
মুঠ উৎসব
‘গণদেবতা’ উপন্যাসে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখছেন, “…কার্তিক সংক্রান্তির দিনে কল্যাণ করিয়া আড়াই মুঠা কাটিয়া লক্ষ্মীপূজা হইয়া গিয়াছে…।” এই ‘মুঠ’ উৎসব বা ‘মুঠ লক্ষ্মী’র পুজো অঞ্চল বিশেষে তা পয়লা অঘ্রাণও অনুষ্ঠিত হয়। “….সকালে উঠে স্নান করে, শাঁখ বাজিয়ে গঙ্গাজল, সিঁদূর, তুলো নিয়ে যাওয়া হয় ধানক্ষেতে। ক্ষেতের ঈশান কোণের আড়াই ঝাড় ধানগাছের ওপর গঙ্গাজল ছিটিয়ে, সিঁদূর দিয়ে ওই আড়াই ঝাড় ধান কেটে ক্ষেতের কাটা ধানগাছের গোড়ায় সিঁদূর মাখা তুলো রেখে, কাটা আড়াই ঝাড় ধানগাছ কলাবৌ-এর মতো পাট, রেশম বা চেলি কাপড়ে মুড়ে শাঁখ বাজিয়ে আনা হয় বাড়িতে” (নৃপেন্দ্র ভট্টাচার্য, ১৩৭৪)। এই মুঠ উৎসবে উঠোনে দেওয়া হয় আলপনা, তার উপর রাখা হয় আলপনা আঁকা পিঁড়ি। ‘মুঠ ধান’ বহনকারী ব্যক্তি এসে দাঁড়ায় সেই পিঁড়িতে। ঘটা করে ধুইয়ে দেওয়া হয় তার পা। এই ধান পুজো করে তুলে রাখা হয়; পরে পৌষমাসে লক্ষ্মীপুজোয় কাজে লাগে — তার খড় রাখা হয় লক্ষ্মীর ঝাঁপি, ধানের গোলা, চালের হাঁড়িতে।
নবান্ন
“নবীন ধান্যে হবে নবান্ন”। কিন্তু তার প্রস্তুতি-পার্বণ কবে? নবান্নের প্রস্তুতি কার্তিক পেরোলে। কারণ খনার বচন আছে, “বেদের কথা না হয় আন, তুলা বিনা না পাকে ধান।” ‘বেদ’ বা জ্ঞানের কথা হল, শালিধান পাকবে তবে নবান্ন। আর ‘তুলা’ বা কার্তিক মাস না গেলে ধান পাকে না। তাই নবান্নের আনুষ্ঠানিকতার সূত্রপাত কার্তিক পেরিয়ে অঘ্রাণের পয়লা তারিখে৷
নবান্নের পূর্বে পাকাধানের আড়াই মুঠ কেটে, বাড়িতে এনে অনুষ্ঠিত হয় লক্ষ্মীপুজো। তারপর নবান্নে লঘু চাল থেকে প্রস্তুত হয় নানান পিঠেপুলি; তা থরে থরে সাজিয়ে দেওয়া হয় দেবভোগ আর পিতৃভোগের জন্য। ধান্যলক্ষ্মী ঘরে এসেছে যে! গৃহাঙ্গন লেপে-পুছে আলপনার নান্দনিকতায় শিল্প-মুখর; ভরা মরাই-এর পাশে তার নানান চিহ্ন-সংকেত; কৃষিজীবী মানুষের কামনার ভাষা নন্দনতত্ত্ব হয়ে দেখা দেয়। তাতে ধানের ছড়া আঁকা, লক্ষ্মীর জু-মর্ফিক ফর্ম প্যাঁচাই-লক্ষ্মীর চিত্র, পদ্মাসন, গো-সম্পদের রূপক-সংকেত, দালান কোঠার সরল অবয়ব, গৃহস্থালি নানান সামগ্রীর চালচিত্র পিটুলির টানে প্রকাশিত।
মুঠ-আনা ধানের গোছাই পুজো হবে নবান্নে। এরই মধ্যে ধান কাটা চলবে, মরাই পূর্ণ হবে, দেবী অন্নপূর্ণা কৃষকের বাস্তুতে অধিষ্ঠান করবেন। মা আর মেয়ে; দেবী দুর্গা আর দেবী লক্ষ্মীর যুগপৎ আশিস সঙ্গে নিয়েই নবান্ন খাওয়া হবে৷ এই খাদ্যের জন্য বিশ্বের অজস্র যুদ্ধ, লড়াই, ছলনা-প্রতারণা। গরীব কৃষক সকলকে খুশি করে তবেই নিজের ধানটুকু রাখতে পেরেছে। নবান্নের পশ্চাতে তার সংগ্রামের এক দীর্ঘ অধ্যায়। নলপুজোতে মা-লক্ষ্মীর ‘সাধ-ভক্ষণ’ করিয়ে ‘ধান ডেকে’ যে আশার আলো আশ্বিন সংক্রান্তিতে দেখেছিলেন কৃষক, তাই আজ সোনালী সন্তানে বাস্তব হয়ে উঠেছে মুঠপুজোয়। মুঠোর মধ্যে আজ ধান্যকন্যা।

আরও পড়ুন : বাংলার কৃষিকৃষ্টির বারোমাস্যা – পর্ব ২

Share it