ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
অগ্রহায়ণ সংক্রান্তি
বাংলা পঞ্জিকাবর্ষের অষ্টম মাস অগ্রহায়ণ। হেমন্ত-মরশুমের পরিসমাপ্তিতে পাকা ধানকে কেন্দ্র করেই তার কৃষি-সংস্কৃতি। অঘ্রাণ ক্ষেতে ‘মধুর হাসি’, ‘ফসলের সুবর্ণ যুগ’ নিয়ে আসে, আর তাই এ ‘লক্ষ্মীর মাস’। ব্রীহি ধানের উৎপাদন প্রাবল্যেই একসময় অঘ্রাণকে বছরের প্রথম মাস বা ‘মার্গশীর্ষ’ ধরা হত। বছরের আগে আসে বলেই অগ্রহায়ণ (অগ্র=আগে, হায়ণ=বছর); তার সংক্রান্তি বা সঞ্চারেও তাই ধান্যলক্ষ্মীর পারিপাট্য। এই সময়ে আকাশে ‘মৃগশিরা’ তারার চাহনি; সেই থেকেই ‘মার্গশীর্ষ’।
‘গণদেবতা’ উপন্যাসে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখছেন, “অগ্রহায়ণ সংক্রান্তিতে খামারে লক্ষ্মী পাতিয়া চিড়া-মুড়কি, মুড়ি, মুড়ির নাড়ু, কলাই ভাজা পুজো হইয়াছিল।” রাঢ় অঞ্চলে হৈমন্তী ধান মাড়াই ও ঝাড়াই-এর শুভ পর্ব হিসাবে অনুষ্ঠিত হয় ইতুলক্ষ্মী ব্রত। কার্তিক সংক্রান্তিতে যে ইতু পুজোর সূত্রপাত, অঘ্রাণের রবিবারগুলিতে তার মেয়েলি আরাধনার পর অঘ্রাণ সংক্রান্তিতে তার পরিসমাপ্তি। সেদিন ইতুর ঘট স্নান করিয়ে, দূর্বা-গাঁদাফুল-চন্দনে সাজিয়ে, নতুন আতপ চালে তৈরি মুঠোপিঠে নিবেদন করে উমনো-ঝুমনোর ব্রতোপাখ্যান শুনতে হয়।
ইতু ব্রতের শেষ পূজায় মুঠো-পিঠে তৈরি হয় চালের গুঁড়ো, কলা, নারকেল,গুড় দুধে মেখে তার মন্ড করে। মন্ডগুলি হাতের মুঠোয় ডিম্বাকৃতি করা হয়, ভেতরে ভরা হয় একুশটি আতপ চাল, তা দুধে-খেজুর গুড়ে সেদ্ধ করা হয়। সংক্রান্তির পরদিন ভোরবেলা ইতু-সরা (নানান ফসলে/উদ্ভিদে পরিপূর্ণ নান্দনিক সরা) নদীতে বা জলাশয়ে বিসর্জন দেওয়া হয়। সরার গাছগুলি হল শুশনি, কলমি, কচু, ছোলা, মটর, মুগ, কলাই এবং যব। অঞ্চলভেদে তার পার্থক্যও চোখে পড়ে। ইতু পুজোর মন্ত্র এইরকম — “শুশনি কলমি লকলক করে,/রাজার ব্যাটা পক্ষী মারে/মারুক পক্ষী শুকোক বিল,/সোনার কৌটো রূপোর খিল,/গুটি গুটি চাদনের বাটি,/বেড়ার চাঁপাফুল/এই নিয়ে তুষ্ট হও/বাবা ইতু ঠাকুর,/ইতু ঠাকুরকে চাই বর,/ধনে পুত্রে বাড়ুক ঘর।”
তুষ-তুষলি এবং টুসু
অঘ্রাণ সংক্রান্তির দিনেই শুরু হয় মেয়েলি ব্রত ‘তুষ-তুষলি’। সারা পৌষ উৎযাপনের পর শেষ হয় পৌষ সংক্রান্তিতে। ধানের ভেতরের শস্যল-দানা বের হবার পর পরে থাকে তার হলদেটে-বাদামি খোসা। নতুন ধানের তুষ নিয়ে কালো গাই-এর গোবর মেখে তৈরি হয় বর্তুল — কোথাও ১৪৪টি, কোথাও ১২৪/৬২/৩১টি। এই গোবর-তুষলীর গুলির মাথায় গোঁজা হয় পাঁচগাছি দূর্বা। অঘ্রাণ সংক্রান্তির দিন কোথাও কোথাও কোনো ব্রাহ্মণ গুলিগুলোকে উৎসর্গ করে দেন; তারপর থেকেই তুষলীর পুজো শুরু হয়ে যায়। তুষ-তুষলিকে নারায়ণ ও লক্ষ্মী জ্ঞানে পুজো করে কুমারী মেয়েরা। পৌষ সংক্রান্তিতে তুষলির মালসায় অগ্নিসংযোগ করে জলে ভাসিয়ে স্নান করে আসতে হয়। এই ব্রত করলে পিতৃ ও শ্বশুরকুলের সুখ-সমৃদ্ধি বাড়ে বলে বিশ্বাস। বাণিজ্যে বা প্রবাসে বসবাসকারী বাবা-ভাই-স্বামী-পুত্রের নিরাপদ জীবন ও প্রত্যাবর্তনের কামনায় অনেকে তুষ-তুষলির ব্রত করেন। রাঢ় বাংলার বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, বর্ধমান, হুগলী জেলায় অঘ্রাণ সংক্রান্তিতে শুরু হয় টুসু উৎসব। এই উৎসবের মূল কেন্দ্রবিন্দু তার গান। মকর সংক্রান্তিতে টুসু বিসর্জন। প্রাচীন বাংলার তুষালি ব্রতই হয়তো টুসুতে পরিণত হয়েছে।
সেঁজুতি ব্রত
সেঁজুতি ব্রতের সমাপ্তি অঘ্রাণ সংক্রান্তিতে যা শুরু হয় কার্তিক সংক্রান্তিতে। এটি সান্ধ্যকালীন কুমারী ব্রত; আঙিনায় আলপনা ও প্রদীপ জ্বালিয়ে যার উৎযাপন। আলপনায় কামনাত্মক বাহান্ন রকমের ছবি আর মনস্কামনা পূরণের বাহান্ন ছড়ার আবৃত্তি — তাতে গ্রামীণ নারীজীবনের সুখ-দুঃখের অকপট অভিব্যক্তি, গ্রাম-বাংলার বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে।
পৌষলক্ষ্মী
গ্রামীণ জীবনে ধানই ছিল ধন, তাই মানুষের মনোভূমে ধান্যলক্ষ্মীর আবির্ভাব। আর মান্যতা পেত গো-ধন — “ধান ধন বড় ধন আর ধন গাই।/সোনারূপা কিছু কিছু আর সব ছাই।” এই ধান্যসম্পদের প্রতি, গো-সম্পদের প্রতি গ্রাম ভারতের চিরকালীন কামনা; তাকে গোলায় গোলায় পূর্ণরূপে ভরার সনির্বন্ধ আকুতি, নিজের সন্তানকে দুধে ভাতে রাখার এক অসামান্য মিনতি — “গোরু জরাধান/রাখো বিদ্যমান।” বাঙ্গালীর যখন গোলায় গোলায় ধান, তখনই গলায় গলায় গান। অন্তরের কথা যেন কথাসাহিত্য হয়ে বের হয়ে আসে আলগোছে “যার আছে গোলায় ধান/তার আছে কথার টান।” পৌষ পার্বণ ও আনুপূর্বিক কৃষি-সাংস্কৃতিক কৃত্য হচ্ছে ধান কেন্দ্রিক অখণ্ড কৃষির পরিপূর্ণ রূপ; ধান্যলক্ষ্মীর অনাবিল উপাসনা। এ হল শালীধানের পৌষালি কৃত্য; হৈমন্তিক ধানের বাস্তবিক সত্য, আমনের ধান চাল হয়ে বেরিয়েছে — এ সেই ব্রীহি ধানের সাংস্কৃতিক চালচিত্র।
বাঙ্গলার মনীষা ভেবেছে, ধান প্রকৃতির দান, ঈশ্বরের কৃপা, সে তো কারও ব্যক্তি সম্পদ নয়! ধানের উৎপাদন-বন্যা যেন ভগবতীর বাৎসল্য ধারা; সে করুণাধারা ধান্যসম্পদ হয়ে আমাদের গোলায় অধিষ্ঠান করে, উদর পরিতৃপ্ত করে।তাই ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় লিখছেন, নবান্নের অন্ন আমরা একা গ্রহণ করি না। আত্মীয়স্বজনকে দিই, পাড়া-প্রতিবেশীকে বিলাই, গ্রামের সকলকে সাধিয়া বিতরণ করি, পশু-পক্ষী, কীট-পতঙ্গ সকলকে অর্পণ করি। কেন?… আমার যে ক্ষুধা, তাহা যে বিশ্বেরও ক্ষুধা.. ।তিনি লিখছেন, লক্ষ্মীকে লক্ষ্মীরূপেই বরণ করিতে হয়, আর যাঁহার করুণা ধান্যের স্বর্ণাবরণের অন্তরালে শস্যরূপে প্রাণপদ, তাঁহারও পূজা করিতে হয়। তবে ইহার মহিমা থাকে। এই জন্যই বুঝি নবান্ন ও পৌষ সংক্রান্তিতে ধান্যলক্ষ্মীর পুজো আর পাল-পার্বণ। আর এজন্য পৌষ কৃষকের উৎসব।
আউড়ি-বাউড়ি
কৃষিজীবী মানুষ পৌষ সংক্রান্তির পূর্বদিবসে পালন করে ‘আউড়ি-বাউড়ি’-র লোকাচার। সে যেন দেবী লক্ষ্মীর মর্ত্য-জীবনচক্র; ইকোসিস্টেমের জলচক্র আর সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ার গ্রামীণ-সংবিৎ। সিন্ধু-সাগরে দেবী লক্ষ্মীর আবাসন, সাগরের জল উবে ধোয়াডানা মেলে মেঘ হয়ে যান দেবী, মেঘে ভরকরে দেবীর উড্ডীন রাঢ়বঙ্গের নীলাকাশে; বর্ষার মেঘমালা বর্ষণ হয়ে জন্ম নেয় মাটির কৈশিক জল আর তারই কাদামাটিতে লালিতপালিত হন ধান্যলক্ষ্মী, কৃষকের সবুজ ক্ষেত্রে। অবশেষে সবুজ হিন্দোল রূপান্তরের পথে হয়ে ওঠে সোনালি ফসল; কৃষকের কাস্তেতে চয়িত হয়ে দেবী গো-যানে চেপে আবির্ভূত হন কৃষকের গৃহে। এটাই হল ‘আউনি’ বা আগমন, কথ্য ভাষায় ‘আউড়ি’। তারপর দেবী সস্নেহে চেয়ে দেখেন বাংলার ঘর-গেরোস্থালী, বুভুক্ষু মানুষের উদরের জঠরের জ্বালা। এটাকেই বলা হয় ‘চাউনি’, বা চেয়ে দেখা, লোকভাষায় ‘চাউড়ি’। তারপর গৃহলক্ষ্মী-বধূর পরম আহ্বানে চঞ্চলা লক্ষ্মী বাঁধা পড়েন গৃহের আনাচে কানাচে, গোলাঘরে, বাক্স-তোরঙের ডালায়, রান্নঘরে, নানান গৃহ-তৈজসে — গোবরের সঙ্গে মুঠকাটা খড় পাকিয়ে অচ্ছেদ্য বন্ধনে দেবীকে অচলা করার মেয়েলি আচার পালিত হয়। এরই নাম ‘বাউনি’ বা বন্ধন, লোকভাষায় ‘বাউরি’। এ তিন লোকসাংস্কৃতিক কৃত্য মিলিয়ে ‘আউড়ি-বাউরি’ লোকাচার। রাঢ়-বাংলায় তার নানান অধিরূপ।
মকর সংক্রান্তি ও পৌষ পার্বণ
‘মকর’ হচ্ছে পৌরাণিক এক মৎস্য, হতে পারে শুশুক বা Gangetic Dolphin. মকরকে বলা হয় গঙ্গাদেবীর বাহন, বরুণদেবেরও বাহন; অনেক চিত্রে দেখা যায় কুমিরের আকৃতিবিশিষ্ঠ জন্তু। হিন্দু বিশ্বাসে উর্বরাশক্তির প্রতীক জলের সঙ্গে মকরকে মেলানো হয়েছে।
‘মকর সংক্রান্তি’-তে সূর্য মকর রাশিতে প্রবেশ করে। আর এই সূর্যোৎসবে দেশের নানা প্রান্তে পালিত হয় শস্যোৎসব। দিনটির গুরুত্বও অন্য কারণেও। দিনটিতে শেষ হয় সূর্যের দক্ষিণায়ন। তারপর শুরু হবে সূর্যের উত্তরায়ন। শীতের অবসানের সূচনা, জড়তা-জড়িমার অবসান-বার্তা।
বাঙ্গলার কৃষিক্ষেত্রে ধান-সম্পৃক্তিতে নানান সময়ে লক্ষ্মী উপাসনার যে বহুতর ধারা পরিলক্ষিত হয়, তার অন্তিম পর্ব হল পৌষ-পার্বণ। কখনো ধানের ক্ষেতে বৃষ্টি আনার মেয়েলি অনুষ্ঠান ভাঁজো; ভাদ্র-আশ্বিনে ইন্দ্র-দ্বাদশী তিথিতে বৃষ্টির দেবতা ইন্দ্রকে তুষ্ট করে নৃত্যগীত পরিবেশন; কখনো গর্ভিণী ধানের সাধ-ভক্ষণ অনুষ্ঠান নল-সংক্রান্তি, ধান ফুলের ছড়া আবৃত্তি; কখনো মুঠকাটা ধান নিয়ে জলের ঝারা ছিটিয়ে, শাঁখ বাজিয়ে, উলুধ্বনি দিয়ে গৃহকর্তার মাথায় চেপে দেবীর গৃহে আগমনবার্তা।
পৌষ-সংক্রান্তিতে পূজিতা হন পৌষলক্ষ্মী; কোথাও পৌষ-পার্বণের নাম-ই ‘নবান্ন’ — “প্রথম অগ্রহায়ণ মাসে নয়া হেউতি ধান।/কেউ কাটে কেউ ঝাড়ে কেহ করে নবান।” শাস্ত্রীয় ও লৌকিক আচার মিলেমিশে একাকার। উৎসবের নাম যাই হোক, তা আদতে ধান্যোৎসব, যার ভরকেন্দ্র জুড়ে আছে নানান শালীধানের স্তূপ — “পাকে ধান্য নানা জাতি/কতো হীরা লীলামতি।” দেবীর আবরণ ও আভরণ হয়ে ওঠে নানান ধান-বৈচিত্র্য; কোনোটি দেবীর আলতা, কোনটি পাসুলি, কোনটি আবার গলার সাতনরী হার; চুলের সৌকর্য, সিঁথির অলঙ্কার আর পায়ের নূপুর — “পারিজাত ধান্যের পরিলা বক্ষহার।/ঊরুর উপরে পরেন বড় শোভা তার।।/সূর্যভোগ চন্দ্রমণি কোমরে পরিল।/নয়ানে অঞ্জন লক্ষ্মীকাজল করিল।।/মুক্তাশাল সিঁথায় সিন্দূর শোভা পায়।/করবী আঁটিল ধান্য কামিনীজটায়।”
অবশেষে এসে যায় পৌষ সংক্রান্তি; সূর্য ধনু রাশি থেকে মকরে সঞ্চারিত হন, তাই এর নাম ‘মকর সংক্রান্তি’; এই দিন থেকেই সূর্য দেবতার উত্তরায়ণ যাত্রা, তাই এর নাম ‘উত্তরায়ণ সংক্রান্তি’। বাঙ্গলায় এটি ‘পিঠেপরব’ আর বসতভিটায় বাস্তুপূজার দিন। পৌষপার্বণের দিন কিংবা তার পূর্বদিনে তুলসীমণ্ডপে অনুষ্ঠিত হয় এই পূজা। কোথাও ‘ঝিকা’ গাছের ডাল কেটে এনে তার তলায় পুজো হয়, মাটির হাঁড়িতে পাটশলমির আগুনে দুধ-চাল-বাতাসা ফুটিয়ে ‘চরু’ রেধে বাস্তুদেবতার ভোগ তৈরি করেন পুরোহিত। পৌষ-পার্বণের দিন উঠোনে মড়াই-এর পাশে পূজিতা হন পৌষলক্ষ্মী।
পৌষমাসের শেষ সপ্তাহব্যাপী গ্রাম-বাঙ্গালায় পিঠেপুলির সমারোহ। নতুন চালের গুঁড়ি বা ‘সবেদা’ (সবেদা ফলের শাঁস জিভে যেমন দানাময় অনুভূতি আনে, চালের গুঁড়িও সেই গ্রোথনে ভাঙ্গা হয়, তারই অনুষঙ্গে এই নাম), খেজুরগুড়, নারকেল কোড়া, কলাই ডালের মণ্ড, মুগডাল সিদ্ধ, ক্ষীর ইত্যাদি দিয়ে প্রস্তুত হয় নানান সুস্বাদু খাবার। পৌষপার্বণের দিন তার এলাহি সমারোহ — চন্দ্রপুলি, মোহনবাঁশি, ক্ষীরমুরালী, চন্দনপাটা; তৈরি হয় সেদ্ধ পিঠে, ভাজা পিঠে, সরুচাকলি; নানান বৈচিত্র্যের চিতোই পিঠে, গোকুল পিঠে, পাটিসাপটা, পাকান, ভাপা, কুলশি পিঠে, কাটা পিঠে, চাপড়ি, চুটকি, নকশি, হাঁড়ি পিঠে, ঝুড়ি পিঠে, পাতা পিঠে, তেজপাতা পিঠে, পোয়াপিঠে, ফুলঝুরি পিঠে, খেজুরপিঠে, চুষিপিঠে ইত্যাদি। বাংলার কোনো বনবাসী কৌমসমাজে তৈরি হয় মাংসপিঠে আর সব্জি পিঠে।
পৌষপার্বণের দিন বাঙ্গলার উঠোন-এগনা এক আশ্চর্য নান্দনিকতায় ভরে ওঠে; গোবরজলে নিকোনো গোটা উঠোন জুড়ে আলপনার নানান সৌকর্য। ধানের ছড়া, লক্ষ্মীর পদচিহ্ন, দেবীর গয়না, চাষের উপকরণের চিত্র — গোরু, লাঙল, জোয়াল, মই আঁকা হয় পরম আনন্দে; পৌষ গাদা থেকে পুজোর সামিয়ানা, পুজোস্থল থেকে গৃহ-সিংহাসন — সর্বত্রই মা লক্ষ্মীর শুভ পদচিহ্ন আঁকা। পিটুলিগোলা পায়ে পা ফেলে ফেলে দেবী কৃষকের গৃহে আসবেন, হবেন অচলা। যেহেতু বাইরে পুজো করে গৃহে লক্ষ্মী আনার ব্যবস্থা তাই কোথাও এর নাম ‘বাহির লক্ষ্মীপূজা’। লক্ষ্মী পূজিত হবার পর রাতে যখন তাঁর বাহন পেঁচা বা শেয়াল (দক্ষিণ দামোদর অঞ্চলের বিশ্বাস) ডেকে ওঠে তখন গৃহকর্ত্রী লক্ষ্মী তুলে ঘরে আনেন তাঁকে। বাঙ্গলার কোনো কোনো অঞ্চলে পৌষপার্বণের সমাপ্তি অনুষ্ঠান হল ‘পৌষ-আগলানো’। বাঙ্গালি রমণী পৌষ বন্দনা করে গেয়ে ওঠে, “এসো পৌষ যেও না/জন্মে জন্মে ছেড়ো না।/পৌষের মাথায় সোনার বিঁড়ি,/হাতে নড়ি কাঁকে ঝুড়ি,/পৌষ আসছে গুড়ি।/আনবো গাঙের জল/ঘরে বসে নেয়ো খেয়ো।/বাহান্ন পেটটি হয়ো/ঘরে বসে পিটে খেয়ো।/এমন সোনার পৌষ জন্ম জন্ম হয়ো।” কোথাও বানানো হয় ‘পৌষবুড়ি’-র গোবরমূর্তি। সোনার পৌষকে ছাড়া যাবে না, তাকে বাঁধতে হবে, শস্য-সম্পদের শ্রীবৃদ্ধি কামনা করতে হবে। বাঙ্গলার নারী তাই ঘরের আঙিনায় সোহাগি পৌষকে নানান মৌখিক সাহিত্যের ঝাঁপি নিয়ে আগলায়।
বাঙ্গলার গ্রামে গ্রামে পৌষমাসের শুক্লপক্ষের বৃহস্পতিবার পৌষলক্ষ্মীর পুজো অনুষ্ঠিত হয়। এ দেবীর অ্যানথ্রোপোমর্ফিক প্রতিমাপূজা নয়, নতুন ফসলের নৈবেদ্যে, নতুন ধানের অলঙ্কার নির্মাণ করে, নতুন চালের গুঁড়িতে প্রস্তুত লক্ষ্মীদেবীর পদচিহ্ন এঁকে দেবীর আরাধনা — শস্যদেবীর বোটানিক্যাল ফর্ম যা ‘কোজাগরী লক্ষ্মী’ থেকে দৃশ্যতই আলাদা। ধনের দেবীর তুলনায় ধানের দেবীর প্রকাশ মূর্ত হয়ে ওঠে, সমগ্র বাঙ্গলা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এক শস্যদেবীর ঐতিহ্য।
পৌষপার্বণের অপরিহার্য আঙ্গিক তার অনুপম আলপনা। আলপনার ঠাট, রূপক সংকেত নিয়ে অনেক গবেষণাই হয়েছে। আলপনা যখন ‘the art of drawing ails (embankment)’ তখন তার কৃষি-সম্পৃক্ততা অবশ্য বিবেচিত। বর্তমানের আলপনায় যে জ্যামিতির প্রকাশ, তার সূত্রপাত হয়তো জমি তৈরি আর তা সমতল করে তোলার প্রাচীন প্রক্রিয়া থেকে। জোয়াল-বাহিত আদি লাঙ্গলের মৃত্তিকা খননে তৈরি হয়েছিল মাঠের আলপনা, তার দুপাশে বলদ-গরুর পদচিহ্ন, জমি কর্ষণে উঠে আসা পোকামাকড়ের লোভে ধেয়ে আসা পাখ-পাখালির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পদচিহ্ন, সর্বোপরি মাঠভর্তি পাকা ফসলের স্বতন্ত্র সমারোহ — সব মিলিয়ে মানুষের সহজাত নান্দনিকতায় গড়ে উঠেছে ব্রত-পূজার আলপনা, তাতে অনবধানে মিলেমিশে একাকার অন্তরে উদ্ভাসিত প্রকৃতির কৃষি-বাস্তুতন্ত্র। মানুষের মনে জারিত হয়ে আলপনা হয়ে ওঠে কৃষিজীবী মানুষের জাদুবিশ্বাস আর নান্দনিকতার মিলিত ফসল।
শুধু যে পৌষলক্ষ্মীর পুজোর স্থলেই আলপনা আঁকা হয়, তা নয়; আলপনা দেওয়া হয় সংরক্ষিত বীজধান রাখার মাটির কলসিতে এবং তার বেদীতে। আলপনা দেওয়া হয় পৌষ সংক্রান্তির পর দিনও; এদিন কোনো কোনো জায়গায় অনুষ্ঠিত হয় ‘যাত্রালক্ষ্মীর পুজো’। কোথাও এর নাম ‘বাউনি পুজো’। উঠোনের মাঝে কৃষিসরঞ্জাম রেখে চারপাশ জুড়ে আঁকা হয় আলপনা। যে সরঞ্জাম দিয়ে এ যাবৎ কৃষিকাজে সাফল্য এসেছে, আজ তারই ধন্যবাদাত্মক চিন্তন-পূজন; আজ সেগুলিরই কাদামাটি ধুয়ে পরিচ্ছন্ন করার দিন। এই আলপনা-বিলাসে কী না নেই! জোয়াল, লাঙল, নিড়ানি, কাচি, খুরপি, কাস্তে, কোদাল, শাবল, দা, কুড়ুল। কোথাও তার প্রতিরূপগুলিও সহজ সরল টানে আঁকা হয়; যেন গৃহের শিশু, বালক-বালিকাকে কৃষিযন্ত্রপাতির অবয়ব চেনানোর ও কার্যকারিতা বোঝানোর এক বার্ষিক মরশুম।
ক্ষেতের ধান প্রথমে এসে কৃষকের খামারে ওঠে, তারপর মাড়াই-ঝাড়াই-এর পর যায় গোলায়। ধান-রক্ষিত খামারেও তাই মা লক্ষ্মীর অধিষ্ঠান। কৃষক-রমণী তাই খামারেও আঁকেন নানান আলপনা — লক্ষ্মীর পদচিহ্ন, পদ্মফুল। যেদিন প্রথম ধান খামারে মাড়াই করা হবে, সেদিন খামার পুজো করার অনুষঙ্গেও মেহীখুঁটি, মুঠ-ধানের মুঠি, ধামাকুলো, দাওনদড়ি ও বলদের পাশে দেওয়া হয় ‘রেখা-আলপনা’। নবান্নের দিন কোনো কোনো জায়গায় চাল দিয়ে গুঁড়ি আলপনা দেওয়ার চল আছে। বাড়ির সদর দুয়ার থেকে লক্ষ্মীর আসন পর্যন্তও আঁকা হয় আলপনার নানান ঠাট। এছাড়া লক্ষ্মী-গোলাকে কেন্দ্র করে বিন্দু দিয়ে শুরু করে উপর্যুপরি ক্রম বর্ধমান বৃত্তাকার আলপনা, তাতে জুড়ে থাকে মই-এর নকশা। গোলার গায়েও আলপনা দেওয়া হয়। এছাড়া পৌষ-পার্বণ উপলক্ষে লক্ষ্মীব্রতের চালিতে আঁকা হয় প্যাঁচার ঠাট।
‘পৌষপার্বণ’ এক শান্তি আর সমৃদ্ধির উৎসব। ভারতবর্ষের নানান অঙ্গরাজ্যে তার বহুধা বিস্তৃতি। কোথাও এর নাম ‘পোঙ্গাল’, কোথাও ‘লোহরি’, কোথাও ‘ভোগালি বিহু’, আবার কোথাও ‘ইল্লুবিল্লা’। এরকমভাবে কোথাও এর নাম ‘খিচরি’, ‘উত্তরায়ণ’, ‘মাঘী’, ‘তিলগুল’, ‘সকরাত’ প্রভৃতি। তামিল জনগোষ্ঠী এই সময়েই (১৪ থেকে ১৭ ই জানুয়ারি) পালন করে ঐতিহ্যবাহী ফসলোত্তর ‘পোঙ্গাল’ উৎসব। অনুষ্ঠানকৃত্য অনেকটা নবান্নেরই মত। এই গ্রামীণ উৎসবে সালোকসংশ্লেষের দেবতা সূর্যের প্রতি জানানো হয় অপরিসীম কৃতজ্ঞতা, ফসল ও গবাদি পশুর প্রতি জ্ঞাপিত হয় অকুণ্ঠ ধন্যবাদ। কর্ণাটক প্রদেশে এই উৎসবেরই ভিন্ন নাম ‘ইল্লুবিল্লা’ এবং ‘মকর সংক্রমণা’। চারদিন ব্যাপী পোঙ্গালের চারটি ভিন্ন নাম — ভোগি পোঙ্গাল, সূর্য পোঙ্গাল, মাতু পোঙ্গাল এবং কানুম পোঙ্গাল। তামিল ও তেলেগুতে ‘পোঙ্গাল’ শব্দের অর্থ হল ‘হাঁড়িতে সেদ্ধ ভাত’; অতএব এ ভাতের-ই উৎসব। নতুন চালের ভাত খেয়ে নববর্ষ উৎযাপনের এক কৃষিকৃষ্টি। এদিন সেই চালের গুঁড়ো দিয়েই বানানো হয় ‘কোলম’ আর তা দিয়েই আঁকা হয় আলপনা। পরিধান করা হয় নববস্ত্র, বন ফায়ার করে পুড়িয়ে ফেলা হয় অপ্রয়োজনীয় জিনিস, হতে পারে তা ফসলের খড়-নাড়াও; তার ছাই দিয়ে কৃষিজমি উর্বরা হবে। এদিন বাড়ির প্রবেশদুয়ার সাজানো হয় কাটা আখগাছের কাণ্ড দিয়ে, তাই বাজার জুড়ে আখের ব্যাপক আমদানি। বাড়িতে তৈরি হয় তিল ও নারকেলের নানান ভোজ্যবস্ত।
লালুব্রত/মাঘমণ্ডলের ব্রত
রানী চন্দ উল্লেখ করেছেন ‘লালুব্রত’-র আরেক নাম ‘লাউল্যার বর্ত’। ব্রতের জন্য ছোটো-ছোটো কাঠের পিঁড়ানো হয়। পিঁড়ির উপর শীতের বিকেলে পুকুরপাড়ের নরম মাটি দিয়ে স্তূপ গড়া হয়, সেটাই লালু — না শিব না মন্দির। বিকেলে তোলা হয় রঙ-বেরঙের ফুল, যা সারারাত তাজা থাকবে, ভোরেরও সতেজ দেখাবে। সন্ধ্যায় সেই ফুল দিয়ে লালু সাজানো হবে, ফুলে ফুলে লালুর সর্বাঙ্গ ঢেকে যাবে, একটুও গা দেখানোর জো নেই। হলুদ অতসীর বোঁটা লালুর গায়ে গাঁথা হয়, গাঁদা-টগর-কলকে ফুলে সজ্জিত হয় লালুর দেহ ও পিঁড়ি। পরদিন ভোরবেলা ঘুম-ভরা চোখ নিয়ে লালুর পিঁড়ি সঙ্গে করে কুয়াশা ঠেলে দুই গাঁয়ের পথ চলা, হাতে ফুলের সাজি — শিশিরে ভেজা মাটিতে সকলের পা ভিজে যায়। ভোরের শুকতারা তখন জ্বলজ্বল করে। পুকুরের ঘাটলায় জলের ধারে সিঁড়িতে লালু বসানো হয়, জলের উপর তখন ঘন কুয়াশার পরত, এই কুয়াশাই ব্রতচারিণী ভাঙ্গবে, তবেই সূর্যদেব ঝিকিমিকি দিয়ে পুবের আকাশে উঠবেন — এটাই হল লালুব্রত। অন্য বালিকারাও একে একে আসে। ছড়া সুর করে কেটে ফুল নিয়ে জলে ফেলা হয় — “উঠো উঠো সূর্যিঠাকুর ঝিকিমিকি দিয়া,/না উঠিতে পারি মোরা শিশিরের লেইগা।” নীচ থেকে ধীরে ধীরে উঁচু গাছে কুয়া উঠে যায়, ভোর ছেড়ে সকাল হয় বিশ্ব। এমন করেই শীতের একমাস ধরে রোজ রোজ লালু গড়া হয়, ফুল তোলা হয়, লালু সাজানোর পালা চলে আর ভোরের আলো-আঁধারিতে ঘাটলার ধারে নিত্য আচার-আচরণ।
সাবেক পূর্ববঙ্গে প্রচলিত এবং প্রতি মাঘ মাসে পালিত পাঁচ বৎসর ব্যাপী সূর্যোপাসনা মূলক একটি কুমারীব্রত হল মাঘমন্ডল। এই ব্রতের দুটি মূল কৃত্য হল পঞ্চগুঁড়ির রঙ্গিন আলপনা অঙ্কন এবং ‘বারৈল’ বা ‘লাউল’ নামক মৃত্তিকা-প্রতীক নির্মাণ, ফুল-দূর্বা দিয়ে তার সাজসজ্জা ও পূজন।
মাঘমন্ডল ব্রতে আঙ্গিনায় অঙ্কিত হয় ব্রতমন্ডল; তার উপরে গোলাকার সূর্য আর নীচে অর্ধচন্দ্র বা চন্দ্রকলা; মাঝে অয়ন-মন্ডল। অয়ন-চিহ্নের সংখ্যা দ্বারা উপলব্ধ হয় ব্রতের পূর্ণতার বৎসর। আমার মা’র বাপের বাড়ি গ্রন্থে রানী চন্দ লিখছেন, “এক বছরে এক গোলের আলপনা, দু’ বছরে দু গোলের। এক গোলের গায়ে আর একটি বৃত্ত দাগা…তিন বছরে তিনটি বৃত্ত, চার বছরে চারটি — আর পাঁচ বছরে পরপর রেখা টানা পাঁচটি বৃত্তের প্রকান্ড একটা আলপনা”।
শ্রীপঞ্চমী
শ্রীপঞ্চমীতে সরস্বতী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। ‘সরস’ শব্দের অর্থ জল। শুরুতে সরস্বতী ছিলেন জলের দেবী, নদীরূপে পূজিতা। শস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে সরস্বতী নদীর প্রধান ভূমিকা ছিল। বিদ্যার দেবীর ধারণা অনেক পরে। উর্বর নদী উপত্যকায় কৃষির ফলন ছিল পর্যাপ্ত। তাই সরস্বতী নদীতীরে আর্য-ঋষিরা রূপদান করেছিলেন বৈদিক সংস্কৃতির। সেইসূত্রে জলের প্রত্যক্ষ দেবী কৃষি ও উর্বরতাকে ছাপিয়ে হয়ে গেলেন জ্ঞান ও বিদ্যার পরোক্ষ দেবী। সভ্যতার অভ্যুত্থান ও তার ক্রমবিকাশে নদী সবসময় সহায়ক ও সঙ্গত ভূমিকা পালন করে এসেছে। তাই কল্পনা করা যেতেই পারে সরস্বতী নদীর দু’কূলে সৃজিত পলল মৃত্তিকার উর্বর শস্যক্ষেত্র ছিল আর্য ঋষিদের ‘শস্যাগার’।
আবার ‘সরস’ শব্দের অপর অর্থ ‘জ্যোতি’। ঋগ্বেদে সরস্বতীকে পাওয়া যায় অগ্নিরূপ, জ্যোতির্ময়ী এক দেবী রূপে। সরস্বতীর মধ্যে সূর্যকিরণের সপ্তবর্ণের ধারণা VIBGYOR এখানে পরিষ্কার। যেহেতু উদ্ভিদ দেহে বৃদ্ধি ও পরিস্ফূরণের অপরিহার্য শর্ত আলোক ও জল, সরস্বতী তাই সালোকসংশ্লেষ বা Photosynthesis প্রক্রিয়ার অধিষ্ঠাত্রী দেবী। সৌরশক্তির প্রত্যক্ষ প্রভাবে জলের আবর্তন ক্রিয়া সম্পন্ন হয়, জলের সরবরাহকারিণী দেবী সরস্বতীর সঙ্গে তাই কৃষি উৎপাদনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।
‘শ্রী’ অর্থে লক্ষ্মী। মাঘ মাসের শ্রী পঞ্চমী তিথিতে একসময় হয়তো লক্ষ্মীপুজোই হত, এখনও অনেক পরিবারে দেবী সরস্বতীর সঙ্গে দেবী লক্ষ্মীকেও ভক্তি সহকারে ফুল নৈবেদ্য দেন। আর এই দিনটি থেকেই যেন শুরু হয় মুকুল-বিকাশের পর্ব, বসন্তের সৌকর্য, সুপ্তির অবসান, মনের মুক্তির মরশুম। দেবী সরস্বতী উপাসনায় লাগে পঞ্চশস্য, পঞ্চপল্লব; ধান, যব, গম, মুগ, তিল দিয়ে এই পঞ্চশস্যের অর্ঘ্য রচিত হয় আর আম, অশোক, অশ্বত্থ, বট, যজ্ঞডুমুরের বিটপ দিয়ে সাজানো হয় পঞ্চপল্লব।
পলাশপ্রিয়া হলেন দেবী সরস্বতী। পলাশের রক্ত রঙ উর্বরতার প্রতীক, আর ঋতুমতী নারীর রজোদর্শনই প্রাণীজন্মের প্রথম শর্ত। দেবী সরস্বতী তাই উর্বরতার অধিষ্ঠাত্রী রূপে পূজিতা; জলের দেবী, আলোর দেবী উর্বরতার দেবী।
ছাতু সংক্রান্তি
চৈত্র সংক্রান্তির দিনটিকে বলা হয় ‘ছাতু সংক্রান্তি’। আগের দিন বাড়িতে তৈরি করে নেওয়া হয় ছোলার ছাতু, যবের ছাতু, খইয়ের ছাতু। দোকান থেকেও অনেক ছাতু কিনে আনেন৷ অনেক বাড়িতে অসচ্ছলতায় আটা ভেজে তৈরি হয় ছাতু, কোথাও গরীব মানুষ কিনে আনেন সস্তাদরের খেসারির ছাতু। অসাধু দোকানদার অনেক সময়ে ছোলার ছাতুতে খেসারি মেশান। খেসারিতে আগে পক্ষাঘাতের ভয় ছিল, কারণ খেসারীর উন্নত জাত বাজারে আসে নি। বালির কড়াইয়ে ভেজে নেওয়া হয় ছোলা, যব ইত্যাদি। ভাজার সময় ভারি একটা মিষ্টি গন্ধে ভরে থাকে চারপাশটা। তারপর লোহার হামানদিস্তায় গুঁড়ো করে নেওয়া হয় ভাজা ছোলা, যব। তার দানাময় গুঁড়ো এরপর শিলে বেটে নেওয়া হয়। এছাড়া চাল ভেজে তৈরি হয় মুড়ি, এই মুড়ি গুঁড়িয়ে যে ছাতু হয়, তা অসাধারণ খেতে। আটার ছাতুতে অনেক সময় অম্বল হয়। ছোটো ছেলেমেয়েরা কে আর অম্বলের ধার ধারে! চৈত্র সংক্রান্তির দিন সকাল সকাল স্নান করে ছাতু খাওয়ার আলাদা আনন্দ। সেদিন ছাতুই জলখাবার। সঙ্গে থাকে ভেলিগুড়, কাঁঠালিকলা, দই, সন্দেশ। উল্লাসই নেমে আসে, সব বাচ্চারা নাচানাচি করতে থাকে। বাড়িতে বাড়িতে রকমারি ছাতুর আয়োজন। কারও বাড়ি গেলেও ছাতুমাখা পরিবেশিত হয়। উপাদান, পরিমাণ আর মাখার গুণে এক এক বাড়িতে এক এক স্বাদের ছাতু।
রানী চন্দের লেখায় পাই, “চৈত্র সংক্রান্তি — ‘ভাইছাতুর’ দিন। তিন মাথায় (তে-পথের মোড়ে) ভাই দাঁড়ায়, বোন মুঠো মুঠো খইয়ের ছাতু ভাইয়ের পায়ের ফাঁক দিয়ে উড়িয়ে দেয় — বার বার তিন বার। বলে — ‘ভাইয়ের শত্রু নিপাত হোক।’ মার অনেক ভাই, মা অনেক ছাতু ওড়ান। তে-মাথার পথটা সাদা হয়ে যায়।” আমার মা বলতেন পূর্ব পাকিস্তানে থাকতে এই প্রথা দেখেছেন, করেওছেন। ছাতুতে সাদা রাস্তায় কুকুর চেটে যায়। নানান পিঁপড়ের দল কয়েক ঘন্টার মধ্যে বাকি ছাতু মুখে করে নিয়ে গর্তে ঢোকে। নবান্নের ‘কাক-বলির’ মতোই প্রকৃতির রাজ্যে নানান প্রাণীকূলের প্রতি কৃতকৃত্য। কিন্তু উদ্বাস্তু বাঙালির হাতে তখন পয়সা কই ছাতু ওড়ানোর! তাই বলা হত, সেদিন ছাতু খেলে শত্রু নিধন হয়।
চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন নীলপুজো। সারাদিন নির্জলা উপবাস থেকে বিকেলে শিব মন্দিরে জল ঢেলে মায়েরা নীলের বাতি দেখান। প্রত্যেক সন্তানের জন্য মঙ্গল কামনা করে মাটির প্রদীপ জ্বালানো হয়। মায়েরা বাড়িতে এসে শিবের শতনাম আবৃত্তি করেন আর প্রণাম মন্ত্র উচ্চারণ করেন। শিবপুরাণ থেকে পাঠ করে শোনানো হয়।
এদিন মায়েদের ভাত খাওয়া মানা। সকালে বড়দানার সাগু ভিজিয়ে রাখা হয়। বাড়ির আসে বেল, কাঁঠালি কলা, তরমুজ, শশা, ফুটি, শাঁকালু, কদমা, বাতাসা, ভেলিগুড়। কাঁচাদুধ দিয়ে সাগু মাখার নিয়ম। অনেক সময় মাটির সরায় কাঠের আগুনে দুধ ফুটিয়ে নেওয়া চলে। মায়েরা শিবলিঙ্গে জল ঢেলে এসে ভেজানো সাগু মাখেন, বাড়ির মেয়েরা ফল কেটে দেন, বেলের পানা তৈরি করেন। এরপর সারাদিনের সাংসারিক কাজ সেরে উপবাসী শরীরে ফলমিষ্টি-সাগু পড়লে তন্দ্রায় জড়িয়ে আসে মায়েদের চোখ। পরদিন ছাতু সংক্রান্তি, সকালে নানান লোকাচার পালন করতে হবে। তাই মায়েরা সবাই সেদিন সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়েন। দূরে কোথা থেকে শিবযাত্রার গান মাইকে বেজে ওঠে, “শিব ঘোছাও আমার মনের ভ্রম/ব্যোম ব্যোম ব্যোম ব্যোবোম ব্যোম।”
আরও পড়ুন : বাংলার কৃষিকৃষ্টির বারোমাস্যা – পর্ব ১