দিঘায় জগন্নাথ মন্দিরে দ্বারোদঘাটনের পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
Share it


শ্রীধর মিত্র, দিঘা: বহু প্রতিক্ষিত দিঘায় জগন্নাথ ধাম মন্দিরের শুভ উদ্বোধন হল। উদ্বোধন করলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গে ছিলেন উপস্থিত বিশিষ্ট অতিথিরাও। সকালে জগন্নাথ দেবকে স্নান করিয়ে রাজবেশ পরানো হয়েছে। পাশাপাশি রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহেও প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। পুজো হয়েছে সুদর্শনা, বিমলা এবং মহা লক্ষীরও। এই পুজোর জন্যে ওড়িশার পুরীর থেকে এসেছেন ২৫ জন ব্রাহ্মণ। আছেন ইসকনের সেবাইতরা। মন্দিরের চারটি তোরণ করা হয়েছে।

দ্বারোদঘাটনের আগে বক্তব্য রাখেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সকলের সহযোগিতা ছাড়া এই মন্দির (Jagannath temple) সম্ভব ছিল না বলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন,”ধর্ম তো কখনও মুখে প্রচার করা যায় না। ধর্ম হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়। মানুষের আস্থা, ভরসা, বিশ্বাস — ভালবাসা রাখাই ধর্ম।” অক্ষয় তৃতীয়ার পূর্ণ শুভ লগ্নে বুধবার বেলা তিনটে ১১ মিনিটে মুখ্যমন্ত্রী জগন্নাথ ধাম মন্দিরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। ধ্বজা, চামর সহ অন্যান্য পুজোর সামগ্রী মুখ্যমন্ত্রী ইসকন ও অন্যান্য পুজোর উদ্যোক্তাদের হাতে ইতিমধ্যেই তুলে দিয়েছেন। প্রভু জগন্নাথের বন্দনার মাধ্যমে মন্ত্রী তথা বিশিষ্ঠ সংগীত শিল্পী ইন্দ্রনীল সেনের গান দিয়ে সূচনা হয়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জগন্নাথ, বলভদ্র, সুভদ্রার বিগ্রহের সামনে দাঁড়িয়ে প্রভুর আরাধনা আরতি করেন।

মঙ্গলবার পুণ্যাহুতির মাধ্যমে শেষ হয়েছিল গত সাতদিনের যজ্ঞপর্ব। মুখ্যমন্ত্রী মহাযজ্ঞ শেষে জানিয়েছিলেন, “পর্যটনের ক্ষেত্রে আন্তজার্তিক স্থান হয়ে উঠেছে দিঘা। আমরা গর্বিত, দেশও গর্বিত। এক সুন্দর স্থাপত্যের কাজ। পুরীর জগন্নাথ মন্দির থেকে অন্যতম দ্বৈতাপতি রাজেশও অন্যান্য অনেক জনকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। মন্দিরের নিত্যদিনের পূজার্চনার ভার দেওয়া হয়েছে ইসকন কতৃপক্ষের হাতে। আদ্যাপীঠ থেকে ব্রহ্মচারী মুরাল ভাই এসেছেন, দক্ষিণেশ্বর বেলুড় মঠ,কামারপুকুর- জয়রাম বাটি সব জায়গা থেকেই সমস্ত ধর্মের এ ছাড়াও কচুয়া ধাম থেকে ও অনেক প্রতিনিধিরাও এসেছেন জগন্নাথ ধাম মন্দিরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে।” পুজোর সময় পুরোহিত রাজেশ সহ অন্যান্য পুরোহিতরা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে গোত্র জিজ্ঞাসা করলে তিনি জানিয়েছেন যে, “আমি সকলের জন্য পুজো করি। মা-মাটি আমার গোত্র। আমি সকলের জন্য প্রার্থনা করি, আজও সকলের মঙ্গলের জন্য অর্পণ করা হল। মা-মাটি-মানুষ ভাল থাকলে আমিও ভাল থাকি। এই মন্দির উন্মাদনার প্লাবন তৈরি করবে। যে কেউ যে কোনও জায়গাতে যেতে পারেন। ধর্ম কারও একার নয়। যার যেখানে ইচ্ছা যাবেন, সমস্ত তীর্থস্থানই সবার জন্য।”

মঙ্গলবার বিকালে চারটায় মহাপুজো সেরেছেন। ওখানে মনসা মণ্ডপ বসানো হয়েছে। বসানো হয়েছে তুলসী গাছ। মঙ্গলবার মুখ্যমন্ত্রী নিজের হাতে তা রোপন করেছেন। রাজেশ দ্বৈতাপতির হাত থেকে ধ্বজা নিয়ে মূল মন্দিরের চূড়ায় তার উত্তোলন করা হয়। এখন থেকেই প্রতিদিন সন্ধ্যায় ধ্বজা উত্তোলন করা হবে। এরপর যজ্ঞকুণ্ডের আটচালায় আসেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, জগন্নাথদেবের মূল মন্দিরের সামনে হোম যজ্ঞের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, নিয়ম নীতি মেনে রাজেশ দ্বৈতাপতি মুখ্যমন্ত্রীকে পুজোপাঠ করান। যজ্ঞকুণ্ডে ঘি আহুতি দেন এবং প্রদক্ষিণ ও আরতি করেন। কাঁসর বাজিয়ে মন্ত্রচ্চারণ করে পূজাও করেছেন তিনি। শঙ্খ ও বাজিয়েছেন। হাতে চামর দুলিয়ে আরতি করেছেন। ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে আহুতি দিয়েছেন। পুরোহিতরা সারাদিন উপোবাস করে পুজো সম্পন্ন করেছেন। মহাযজ্ঞের পর পুরোহিতদের নিজের হাতে লেবুর জল তুলে দিয়েছেন। যজ্ঞ সম্পূর্ণ করার জন্য যে আহুতি দেওয়া হয়, তাকেই “পূণ্যাহুতি” বলা হয়”। মুখ্যমন্ত্রীর হাত দিয়েই গত সাতদিনের যজ্ঞ তথা মহাযজ্ঞের সমাপ্তি ঘটেছে মঙ্গলবার সন্ধ্যায়। দিঘায় জগন্নাথ ধাম মন্দিরের শুভ উদ্বোধন উপলক্ষে গত ২৩ এপ্রিল থেকে শুরু হয়েছিল পূজার্চনা, যজ্ঞ, মন্ত্রপাঠ। গত এক সপ্তাহ ধরে চলেছিল যজ্ঞ-আহুতি। তাতে দেওয়া হয়েছিল ২ কুইন্টাল ঘি, আতপ চাল, তিল, ৩ লরি বেলকাঠ, আমকাঠ, এ ছাড়াও নানা ধরনের কাঠও। ১ কোটি ইষ্ট নাম জপ করে ছিলেন পুরোহিতরা। রাতে জগন্নাথ দেবের শয়নের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, শুধু তাই নয়,বাংলার বিভিন্ন জেলা থেকে ফুল এসে পৌঁছেছিল দিঘার জগন্নাথ ধাম মন্দিরে। রাতে জগন্নাথ – বলভদ্র – সুভদ্রাকে পুষ্প বেশে সাজানো হয়েছিল। জগন্নাথ ধাম মন্দিরে উদ্বোধনের পরে সাধারণ মানুষকে প্রবেশ করতে হবে ৩ নম্বর গেট দিয়ে। তারই বিপরীতে দিকে থাকবে পুজোর ডালা সামগ্রীর জিনিস। পুজোর সামগ্রীতে থাকবে কালীঘাটের ক্ষীরের প্যাড়া, পুরীর খাজা, লাড্ডু।

বুধবার মন্দির প্রাঙ্গণে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী ডোনা গাঙ্গুলির ‘দীক্ষা মঞ্জরী’র শিল্পীরা ওড়িশি নৃত্য পরিবেশন করেন। এছাড়াও ভক্তিমূলক সংগীত পরিবেশন করেন অদিতি মুন্সি, জিৎ গাঙ্গুলি, নচিকেতা চক্রবর্তী, ইন্দ্রনীল সেন, শ্রীরাধা বন্দ্যোপাধ্যায়, রূপঙ্কর বাগচী সহ অন্যান্যরা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ১৮ হাজার অতিথি অভ্যাগতদের বিশাল হ্যাঙ্গারে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রীর উদ্বোধের পর অতিথিদের জগন্নাথ ধাম মন্দিরের ভেতরে দর্শন করিয়ে তাদের অতিথিশালায়, হোটেলে জগন্নাথ দেবের ছবি ও প্রসাদ পৌঁছে দেওয়া হয়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সদস্যদের নির্দেশ দিয়েছেন, সারা রাজ্যের মানুষের কাছে প্রভু জগন্নাথের প্রসাদ পৌঁছে দেবার। মন্দির প্রাঙ্গণের আশপাশে লাগানো হয়েছিল জায়েন্ট স্কিন, যার দ্বারা সরাসরি সাধারণ মানুষেরা উদ্বোধনী অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করেছেন। গোটা মন্দির ও আশপাশ সেজে উঠেছে এলইডি ও বিভিন্ন রং-বেরঙের আলোয়। মন্দিরের বিপরীতে সমুদ্র সৈকতে জগন্নাথ ধামের জন্য পৃথক করে ঘাট নির্মাণ করা হয়েছে,যা বুধবার মুখ্যমন্ত্রী উদ্বোধন করেছেন।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণ পত্র দেওয়া হয়েছিল বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু, রবীন দেব, কংগ্রেসের প্রদীপ ভট্টাচার্য, বিজেপির সুকান্ত মজুমদার, দিলীপ ঘোষ এবং বিরোধী দলের নেতা শুভেন্দু অধিকারীকেও। হিডকোর মাধ্যমে পাঠানো হয়েছিল এই সব আমন্ত্রণ পত্র। বিরোধী দলের নেতা শুভেন্দু অধিকারী আমন্ত্রণের চিঠি পাওয়ার পরে জানিয়েছেন, এটা মন্দির নয় এটা একটা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র মাত্র। তবে বিজেপির প্রাক্তন সাংসদ দিলীপ ঘোষ সস্ত্রীক উদ্বোধনের পর সেখানে উপস্থিত হন। অরূপ বিশ্বাস ও কুনাল ঘোষ তাঁকে উত্তরীয় পরিয়ে দেন। পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সস্ত্রীক আড্ডার মেজাজে দেখা যায় বিজেপি নেতাকে।

Share it