যীশু চৌধুরী (বিশিষ্ট সাংবাদিক): বহুদিন ধরে আফগানিস্তানের মানুষ মুক্ত এবং স্বাধীন চিন্তার ঐতিহ্য বহন করে এসেছেন। কিন্তু পাকিস্তানের জন্মের পর থেকে আফগানিস্তানের কার্যত বিপদ শুরু হয়েছে। ভারত ভাগের আগে পাকতুনিস্তান, বেলুচিস্তান এবং কাশ্মীরের মানুষজন আফগান জনগনের মতোনই স্বাধীন চিন্তার বাহক ছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানের জন্মের পর থেকেই এইসব জায়গায় জঙ্গি এবং মৌলবাদী কাজকর্ম ক্রমশই বাড়তে থাকে। এবং তার জন্যে মূলত দায়ী পাকিস্তানের অনিশ্চিত রাজনীতি।
তবে এভাবে পাকিস্তান একা আসেপাশের জনগনের কোনও ক্ষতি করতে পারত না। এই ক্ষতি করার ক্ষমতা তারা অর্জন করেছে আমেরিকার কাছ থেকে অস্ত্র এবং অর্থ ইত্যাদির মদত পেয়ে। বিশেষ করে বাবরাট কারমাল আফগান্তিনের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে সেই সরকারকে উৎখাত করার জন্যে আমেরিকা পাকিস্তানকে ওই মদত দিতে থাকে। পাকিস্তান তখন তাদের গোয়েন্দা বাহিনী ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স (ISI) এবং সেনাবাহিনীর উপর বাবরাট কারমাল সরকারকে উৎখাতের দায়িত্ব দেয়। বাবরাট কারমালের পেছনে অবশ্য সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন ছিল। আমেরিকা ভেবেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন এভাবেই আফগানিন্তানে ঢুকে পড়ে দক্ষিণ এশিয়ার দিকে আরও এগিয়ে আসবে।
পাকিস্তান সেই সরকারকে উৎখাত করার জন্যে বাইরের শক্তি, বিশেষ করে অতি উগ্র মৌলবাদী এবং জঙ্গিদের হাতে অর্থ এবং অস্ত্র দিয়ে আফগানিস্তানে ঢুকিয়ে দেয়। এরাই তালিবান নামে পরিচিত। এদের নেতা ছিলেন ওসামা বিন লাদেন। তিনি আসলে সৌদি আরবের লোক। ফলে আফগানিস্তানে গন্ডগোল পাকানোর জন্য পাকিস্তান বহিরাগতদের সাহায্য নিয়েছিল। তবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর আফগানিস্তানের অবস্থা আরও ঘোরালো হয়। কারমালকে প্রকাশ্য রাস্তায় ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয় তালিবানরা। এবং পাকিস্তানের বকলমে আফগানিস্তানের ক্ষমতা পুরোপুরি চলে যায় তালিবানদের হাতে। কিন্তু এই তালিবানরাই আমেরিকায় ঢুকে বিমান হানা চালিয়ে টুইন টাওয়ার ধ্বংস করে দেয় এবং পেন্টাগনের উপর হানাদারি চালায়। এতেই টনক নড়ে আমেরিকার। তারা বুঝতে পারে আফগানিস্তানে সোভিয়েতকে রোখার নামে একটি বিষবৃক্ষের চারা তারা পুঁতেছিল। আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতিকে বুঝতে গেলে সেই ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার কথা মাথায় রাখতে হবে।
আমেরিকা তারপর প্রত্যক্ষভাবে ফিরে আসে আফগানিস্তানে। ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যু হয় তাদেরই হাতে। কিন্তু, আফগান সীমান্তবর্তী পাকিস্তানি এলাকা পেশোয়ার ও পাকতুনখোয়ার বিভিন্ন দুর্গম অঞ্চলে তারা ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকে। পাকিস্তান যতই অস্বীকার করুক তাদের মদত না থাকলে এটা কখনওই সম্ভব হত না। এবারও আমেরিকা চলে যাওয়ার আগেই তালিবানরা আফগানিস্তানের দখল ফের নেওয়ার চেষ্টা করছে। মনে রাখতে হবে, এই দখলদারি আসলে পাকিস্তানেরই গোপন এজেন্ডা। না হলে কোনও অ-সরকারি সংস্থার পক্ষেই এত অস্ত্রশস্ত্র, যুদ্ধযান, আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা জোগাড় করা সম্ভব নয়। তাই একথা এখন অনেকেই বলছেন আফগানিস্তানে যদি সত্যিই স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র ফেরাতে হয় তাহলে পাকিস্তানকে সব সমস্যা ঝেড়ে ফেলে এগিয়ে আসতে হবে। তাই এই অঞ্চলে এখন পাকিস্তানের গতিবিধি সবচেয়ে বড় প্রশ্নের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে।