শ্রীধর মিত্র: বহু প্রতিক্ষিত পুরীর জগন্নাথ ধাম মন্দিরের অনুকরণে বঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুরের দিঘার জগন্নাথ ধাম মন্দিরের প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ২০১৮ সালে জগন্নাথ ধাম মন্দিরের স্থাপনের কথা ঘোষণা করেছিলেন। ২০২৩ সালের পূণ্য অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে মন্দির নির্মাণের কাজের শুভারম্ভ হয়েছিল। সুদৃর রাজস্থান থেকে বেলে পাথর আনা হয়েছিল মন্দির নির্মাণের জন্য। ওড়িশায় পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের অনুকরণে মন্দিরের উচ্চতা হবে বঙ্গের দিঘা জগন্নাথ ধাম মন্দিরের। মন্দিরের পারিপার্শ্বিক নকশা ও কিছুটা অবিকল একই রাখা হয়েছে। ওই সব স্থানে সমুদ্র সৈকতের আকর্ষণে প্রচুর ভ্রমণ পিপাসুদের সমাগম হয়ে থাকে বছরের সব সময়েই। দিঘায় জগন্নাথ ধাম মন্দির আগামী দিনে বঙ্গ ও অন্যান্য জায়গা থেকে বহু পযটকদের আসা-যাওয়া হবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
বঙ্গের আকর্ষণ বৃদ্ধি ও পর্যটন শিল্পকে আরও উদ্বুদ্ধ করতে এই অভিনব উদ্যোগ নিয়েছিল বঙ্গ সরকার। বঙ্গ সরকারের কোষাগার থেকে ২৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল মন্দিরের জন্য। আনুমানিক ৮ কোটি টাকা ব্যয় করে মন্দিরের নির্মাণের জন্য স্থানীয় ভাবে জমি কেনা হয়েছিল সরকারের তরফ থেকে। বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশ্যেই ঘোষণা করেছিলেন যে, রথযাত্রার সময়েই খুলে যাবে দিঘার জগন্নাথ ধাম মন্দিরের দরজা।পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের অনুকরণে নাম থাকবে দিঘায় জগন্নাথ ধাম মন্দিরের। চলতি বছরের ৭ জুলাই, ২০২৫ সোমবার দিঘায় জগন্নাথ ধাম মন্দিরের রথযাত্রা উৎসব ধূম-ধাম সহকারে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। বঙ্গের সৈকত নগরীর অন্যতম আকর্ষণ প্রত্যক্ষ করার আর কয়েকটা মাস মাত্র। চলতি মাসের শুভ অক্ষয় তৃতীয়ার। পূণ্য লগ্নে ১৬ বৈশাখ,১৪৩২ বঙ্গাব্দের বুধবার স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অতিথি বৃন্দদের উপস্থিতিতে জগন্নাথ ধাম মন্দিরের প্রাণ প্রতিষঠা ও উদ্বোধন সম্পন্ন সম্পন্ন হতে চলেছে।
আগের দিন অর্থাৎ ২৯ হবে মহা হোম যজ্ঞ দিঘার জগন্নাথ ধাম মন্দিরের। প্রশাসনিক সুত্রের তরফ থেকে জানানো হচ্ছে তার আগে ওই দুই দিনের কর্মসূচির বার্তা সাধারণ মানুষের কাছে কী ভাবে পৌঁছে দেওয়া যায়, সে ব্যাপারে পরিকল্পনা করতে হবে পূর্ব মেদিনীপুরে জেলা শাসকদের। উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের তরফে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে স্থানীয়ভাবে সারা অনুষ্ঠানের প্রচার করতে হবে হোল্ডিং, ব্যানার দিয়ে মহল্লায়-মহল্লায়। পাবলিক ডিজিটাল ডিসপ্লের মাধ্যমে অথবা এলসিডি স্ক্রিনের ব্যবহার ও রাখতে হবে সেই প্রচারের জন্য। ইতিমধ্যেই পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের অন্যতম পুরোহিত রাজেশ দ্বৈতপতি বর্তমানে দিঘায় এসে মঙ্গলবার এবং বুধবারের সমগ্র অনুষ্ঠানের তদারকি করছেন। গত বুধবার থেকেই জগন্নাথ ধাম মন্দিরের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়েছেন “ডিরেক্টরেট অফ সিকিয়োরিটিজ”। সম্প্রতি মহা কুম্ভের মর্মান্তিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দিঘির জগন্নাথ ধাম মন্দির উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে উন্মাদনা তৈরি করা যে হবে না, তার আগে থেকেই স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। উন্মাদনা তৈরির কারণেই মহাকুমভে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ও অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটেছিল বলে ও মন্তব্য করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। ফলে “নিয়ন্ত্রিত” ভাবেই আসন্ন জগন্নাথ ধাম মন্দির উদ্বোধন অনুষ্ঠান পালন করতে চাইছে।
নবান্ন আধিকারিক মহলের একাংশের ধারণা, দিঘায় জগন্নাথ মন্দিরের কারণে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে দিঘায় আকর্ষণ আরও অনেকাংশে বেড়ে যাবে, তার নিয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। সেই মন্দিরের গঠনশৈলী ও চোখ ধাঁধানো হবে। ফলে সরকারি প্রচেষ্টায় এই মহতি অনুষ্ঠানের সার্বিক প্রচার – প্রসার দুর থেকে হলেও তার সঙ্গে আরও বেশি বেশি মানুষকে একত্রিত চাইছে নবান্ন। অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে অযোধ্যায় রাম মন্দিরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সাক্ষী ছিলেন দেশ- বিদেশের আপামোর মানুষজনেরা।
আসন্ন (২০২৬) বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রাক্কালে দিঘায় জগন্নাথ ধাম মন্দিরের উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে প্রশাসনের তৎপরতাকে অর্থবহ বলে মনে করছেন বঙ্গের প্রধান বিরোধী দল ও বিশ্লেষকদের একাংশ। আগামী সপ্তাহের শুরুতেই দিঘায় পৌঁছে যাবেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শেষ পর্যায়ের তদারকি এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা খতিয়ে দেখবেন। ২৫০- ৩০০ জন অতিথিরা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দিনে দিঘায় রাত্রি বাস করবেন বলে নবান্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে। তাই সমস্ত সরকারি অতিথিশালা এবং দিঘা শংকরপুর উন্নয়ন পর্ষদের অতিথিশালা ও বে-সরকারি হোটেল ও অগ্রিম সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে সুত্র মারফত জানা গেছে। সাজসাজ রব এখন পূর্ব মেদিনীপুরে দিঘা সৈকত নগরীতে। ইতিমধ্যেই পরিবহণ ও অগ্নি নির্বাপন এবং বিদ্যুৎ বিভাগের মন্ত্রীরা ঘুরে এসেছেন ও বিভাগীয় আধিকারিকদের সঙ্গে আলোচনা সেরেছেন। আগামী সপ্তাহের শুরুতেই চার পাঁচজন মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, ডাঃ শশী পাঁজা, সুজিত বসু ও স্নেহাশিস চক্রবর্তীরা এবং বেশ কয়েকজন সচিব পর্যায়ের আধিকারিকরা গিয়ে তদারকি সারবেন।
দিঘায় জগন্নাথ ধাম মন্দিরে থাকছে জগন্নাথ – বলরাম ও সুভদ্রার মন্দির, স্ব-শাষিত ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ও মন্দিরের নিত্যদিনের পূজার্চনা ও অন্যান্য কাজের জন্য সহযোগী এবং সহকারীদের থাকার জন্য দ্বিতল বিশিষ্ট সুসজ্জিত ঝকঝকে থাকার বাড়ি। এ ছাড়াও থাকছে জগন্নাথ – বলরাম – সুভদ্রার নিত্য ভোগ রান্নার জন্য পৃথক ঘর, স্টোর রুম, পুজোর ডালা সামগ্রীর জন্য ঘর, স্থায়ী পুলিশ চৌকিঘর, অগ্নি নির্বাপন ও জরুরী পরিসেবা এবং অসামরিক প্রতিরক্ষা ও বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য পৃথক ঘর, জরুরি স্বাস্হ্য পরিসেবা কেন্দ্র,পুর ও নগরোন্নয়ন বিভাগের ” হিডকোর অফিস, মূলত তাদের দায়িত্বে থাকবে দিঘায় জগন্নাথ ধাম মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ভার।
মুখ্যসচিবের নেতৃত্বে ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরা হলেন যথাক্রমে বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনের সদস্যরা, এরা হলেন- ইসকনের চার প্রতিনিধি,ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের প্রতিনিধি, সনাতনী ধর্মের সভাপতি, কালীঘাট মন্দিরের সেবাযেত বড় ঘরের জনৈক প্রতিনিধি, পূর্ব মেদিনীপুরের জেলা শাষক, জেলা পুলিশ সুপার, পদাধিকার বলে জেলা সভাধিপতি, স্থানীয় সাংসদ, রামনগর বিধানসভার বিধায়ক,ও বেশ কয়েকটি বিভাগের সচিব পর্যায়ের আধিকারিকরা। সমুদ্র সংলগ্ন জগন্নাথ ধাম মন্দিরের সামনের দিঘা সড়ক সংলগ্ন রেল স্টেশনের কাছে ২০ একর জমিতে এই বিশাল জগন্নাথ ধাম মন্দির। তার সামনের রাস্তায় ২৫ ফুট লম্বা ও ৩৫ ফুট চওড়া বিশাল মজবুত “চৈতন্য দ্বার” তোরণ নির্মাণ যুদ্ধকালীন পরিস্হিতিতে দিন- রাত এক করে শেষ মুহূর্তের কাজ চলছে এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত। অনুরুপ আরও একটি তোরণ পেছনের দিকে ভগ্গারখ্যপুরের দিকে আগামী দিনে হবে।দিঘায় জগন্নাথ ধাম মন্দিরকে পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কার্যক্রম ওড়িশার পুরীর মন্দিরের আচার- আচরণ মেনেই হবে। স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে মিশিয়ে নতুন কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ মন্দিরের ভোগ স্থানীয় মিষ্টান্ন ছাড়াও কালীঘাটের ক্ষীরের পেঁড়া, লাড্ডু ,পুরীর খাজা,ছানার মুড়কি প্রধান ভোগ হিসাবে থাকছে। পুজার সামগ্রী বিক্রীর দায়িত্ব থাকবে “আশার মহিলা কর্মীদের ওপর”।
মন্দিরকে ঘিরে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আবহ আরও দঢ করতে জগন্নাথ মন্দিরের সামান্য দুরে সমুদ্র সৈকত সন্নিকটে পুরনো জগন্নাথ মন্দিরকে মাসির বাড়ি হিসাবে চিহ্নিত করা হবে। পুরীর রথযাত্রায় মাসির বাড়ি পর্বের মতোই দিঘায় এই ঐতিহ্য পালন করা হবে। তিন দেবতা জগন্নাথ – বলরাম- সুভদ্রার জন্য তিনটি পৃথক রথ নির্মিত ইতিমধ্যেই হয়েছে, সেগুলি জগন্নাথ ধাম মন্দিরে সংরক্ষিত থাকবে। পুরীর অনুকরণে এখানেও তিনটি রথের নিজস্ব নাম থাকবে যা রথযাত্রার সময় ব্যবহার করা হবে। রথযাত্রাকে নির্বিঘ্নে করতে মন্দির সংলগ্ন রাস্তা দিঘা রোগকে আগের থেকে আর ও চওড়া করা হয়েছে, যাতে ভক্তদের ও দর্শনার্থীদের যাতায়াতের সুবিধা হয়। এ ছাড়াও দিঘায় জগন্নাথ ধাম মন্দিরের এক অনন্যা সংযোজন হলো ২৫ ফুট লম্বা ও ৩৫ ফুট চওড়া “চৈতন্য দ্বার” । পুরীর স্বর্গ দ্বারে চৈতন্যদেবের মূর্তি রয়েছে, যা দর্শনার্থীদের এক আধ্যাত্মিক অনুভূতি দেয়।
বহু প্রতিক্ষার অবসান ঘটাতে চলেছে চলতি মাসের ২৯ তারিখ মঙ্গলবার সকালে মন্দির প্রাঙ্গণে মহা হোম যজ্ঞের আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে অল্প জায়গার জন্য সীমিত সংখ্যক অতিথিরা ছাড়া অন্য কারুর প্রবেশাধিকার থাকবে না, বেশ কিছুটা দুরে থেকে তার দেখতে হবে। পরদিন অর্থাৎ ৩০ তারিখ বুধবার সকালে মূল জগন্নাথ ধাম মন্দিরের শুভ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী ডোনা গাঙ্গুলির “দীক্ষা মঞ্জুরী” সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের উপস্থাপনায় নৃত্য পরিবেশন ও ভক্তিমূলক সংগীত পরিবেশন করবেন বিশিষ্ট ভক্তিগীতি শিল্পী তথা বিধায়ক অদিতি মুন্সি, জিৎ গাঙ্গুলি ও অন্যান্যরাও। অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মুখ্যসচিব, মন্ত্রিসভার মন্ত্রীরা, অন্যান্য বিশিষ্ট অতিথিরা। মন্দিরের শুভ উদ্বোধন করবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অন্যান্য বিশিষ্ট অতিথিরা।
পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের সঙ্গে দিঘার জগন্নাথ ধাম মন্দিরের কিছুটা তফাত থাকলেও অনেকাংশে কিছুটা সাদৃশ্য খুঁজে পাবেন দর্শনার্থী ও পর্যটকরাও। পুরীর জগন্নাথ ধাম মন্দিরের অনুকরণে দিঘায় জগন্নাথ ধাম মন্দিরের বিগ্রহ বানানো হয়েছে সম্পূর্ণ নিমকাঠ দিয়ে, জগন্নাথ – বলরাম- সুভদ্রার মার্বেলের মূর্তি ও প্রতিষ্ঠা হয়েছে। বঙ্গে ও পালিত হবে ধূমধাম সহকারে রথযাত্রা উৎসব।পুরীর আদলে সোনার ঝাঁটা দিয়ে রথযাত্রার পথকে সাফাই করা গজপতি মহারাজের নেতৃত্বে। দিঘাতেও সোনার ঝাঁটা রাখার ব্যবস্হা করা হচ্ছে মুখ্যমন্ত্রীর নিজস্ব আর্থিক সহাযতায়। জগন্নাথ মন্দিরে প্রতিদিন সন্ধ্যায় গর্ভগৃহের শিখরে ধ্বজা বাঁধার রেওয়াজ আছে, যা আজও বংশ পরম্পরায় চালিয়ে আসছে এক সম্প্রদায়ের মানুষেরা। অনুরূপ ব্যবস্হায় ও দিঘায় জগন্নাথ ধাম মন্দিরে থাকছে। তার জন্য পুরী থেকে লোক ভাড়া করে আনা হচ্ছে। এর জন্য মুখ্যমন্ত্রী পুরীর অন্যতম পুরোহিত রাজেশ দ্বৈতপতিকে বিশেষভাবে অনুরোধ করেছেন ইতিমধ্যে।