দিলীপ গুহ, নয়া দিল্লি: আকাশে আজ কোন্ চরণের আসা-যাওয়া। বাতাসে আজ কোন্ পরশের লাগে হাওয়া। দিল্লির বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশনের একনিষ্ঠ উদ্যোগে, প্রথমবার ৯ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়েছে দু-দিনব্যাপী, ‘বিয়ন্ডবাউন্ডস’ শীর্ষক একটি আন্তর্জাতিক ডকু-শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। দিল্লির এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক ক্যালেন্ডারে, বঙ্গ সংস্কৃতি ভবনের মুক্তধারা প্রেক্ষাগৃহে, প্রতিবছরই নিয়ম করে “সিনে উৎসব” উদযাপন করে, যা অসংখ্য সিনেপ্রেমী দর্শকের কাছে বিশেষভাবে সমাদৃত।
বিগত বছরে,”সিনে উৎসবের” ব্যানারে, নানা ধরণের বাছাই করা উন্নত মানের বাংলা চলচ্চিত্র ভালোভাবে সংগঠিত পদ্ধতিতে করা হয়েছে এবং সেই উৎসব এতদিন প্রাণ পেয়েছে, নানা আঙ্গিকের পূর্ণ দৈর্ঘ্য এবং স্বল্প দৈর্ঘ্যের বাংলা ছায়াছবির সংমিশ্রণে।
২০২২-২০২৫ সালের নতুন কার্যকরী সমিতি গঠিত হওয়ার পর, সমিতি পরিকল্পনা করে, ক্যালেন্ডারে বার্ষিক সিনে উৎসবকে ব্যতিরেকে, বছরের অন্য সময়ে, একটু ভিন্ন ধরণের কিছু অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে,যার মাধ্যমে, রাজধানী দিল্লি প্রবাসী বাঙালিরা তথা অন্য ভাষাভাষীর সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষেরা নতুন কিছু উপহার পেয়ে, সাথে একসূত্রে আরও বেঁধে বেঁধে থাকেন।
বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশন, দিল্লি-এর পক্ষ থেকে প্রদীপ গাঙ্গুলি, সাধারণ সম্পাদক এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, “আপনারা সকলেই অবগত আছেন, দিল্লির বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশন, কয়েকযুগ ধরে, বহির্বঙ্গে বাংলা ভাষার প্রচার ও প্রসারে সর্বদা কাজ করে চলেছে। আমরা বাংলা নিয়ে ভাবতে, বাংলা নিয়ে কথা বলতে, বাংলায় গান গাইতে বিশেষ ভাবে পছন্দ করলেও, আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে, আমাদের চিন্তাভাবনা, আমাদের কর্মপ্রচেষ্টা, আমাদের কর্মকান্ড আরও একটু সুদূরপ্রসারী হোক, ছড়িয়ে পড়ুক বিবিধের মাঝে মহান মিলন ঘটাতে। কারণ নিজের মাতৃভাষাকে, সঠিক ভাবে লালন পালন করতে হলে, এর মিষ্টি সুরকে বিশ্বব্যাপী ভিন্ন সাংস্কৃতিক মনস্ক ব্যক্তিদের কর্ণকুহরে পৌঁছে দিয়ে সমন্বয় সাধন করতে গেলে, সাংস্কৃতিক আদান প্রদান করার বিশেষ প্রয়োজন।”
“আমাদের এই ভাবনাকে বাস্তবায়িত করতেই, এবছর আমরা প্রথমবার বাংলা ভাষাকে জড়িয়ে, বাংলা ভাষায় গঠিত বিভিন্ন পুরস্কার বিজয়ী তথ্যচিত্র ও স্বল্পদৈর্ঘ্যের ফিল্ম দেখানোর সাথে, প্রিয় দর্শকদের কাছে মেলে ধরতে উদ্যোগী হয়েছি, ভারতবর্ষ সহ আরও নানা দেশের, যথাক্রমে ফ্রান্স, বুলগেরিয়া, বাংলাদেশ, ইটালি এবং নেপাল ইত্যাদি জায়গার কয়েকটা নামকরা ডকু-শর্ট ফিল্ম। এই উৎসবে প্রায় দেড় ডজন ছবির সাথে দুটি আন্তর্জাতিক মানের ডকুমেন্টারী ছবি প্রদর্শিত হবে।” তিনি আরও বলেছেন, তিনি কর্মসূচি সম্পর্কে আরও অবহিত করেন, প্রথমদিনে সন্ধ্যায়, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর, এই উৎসবের “বিশেষ ছবি” হিসাবে দেখানো হবে, দিল্লী শহরের এক বাঙালি ছেলে, শ্রী শৌনক সেন পরিচালিত ‘অল দ্যাট ব্রিদস’ ছবিটি, যে ছবি গতবছর “সানড্যান্স ফিল্ম ফেস্টিভালে” ওয়ার্ল্ড সিনেমা ডকুমেন্টারি প্রতিযোগিতায় গ্র্যান্ড জুরি পুরস্কার জিতে আন্তর্জাতিক পরিসরে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। শুধু কি তাই, ছবিটি “কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে” সেরা তথ্যচিত্রের জন্য, গোল্ডেন আই পুরস্কার জেতার পর, সেরা ডকুমেন্টারি ফিচারের জন্য একাডেমি অর্থাৎ অস্কার পুরস্কারেও, প্রথম পাঁচটি ফিল্মের মধ্যে মনোনয়ন পেয়েছে যা তাঁকে সম্প্রতি রাতারাতি বিখ্যাত করে তুলেছে। দিল্লির দূষিত আকাশে, অসুস্থ চিলের শুশ্রুষায় নিয়োজিত দুই ভাইয়ের কাহিনী নিয়ে বর্ণিত ‘অল দ্যাট ব্রিদস’ ছবিটি, দেশ বিদেশের বহু নামি পুরস্কারে ভূষিত হওয়ার পর থেকেই, প্রায় সকলেই এখন দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কের ছেলে শৌনক সেনের অন্তর্নিহিত চলচ্চিত্র ভাবনা, তার মেজাজ ও রূপক নিয়ে আলোচনায় মশগুল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, শৌনক দিল্লীর জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হয়ে জহর লাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছেন। শৌনকের একাডেমিক এবং পেশাগত কাজের ধারাকে সমর্থন করে, বিভিন্ন সংস্থা যথাক্রমে, ২০১৩ সালে “ফিল্ম ডিভিশন অফ ইন্ডিয়া” ওনাকে ডকুমেন্টারি ফেলোশিপ দিয়েছে। এছাড়া তিনি ২০১৪ সালে CSDSসারাই ডিজিটাল এবং সোশ্যাল মিডিয়া ফেলোশিপ, ২০১৬ এবং ২০১৮ সালে প্রো হেলভেটিয়া রেসিডেন্সি এবং চার্লস ওয়ালেস ফেলোশিপ লাভ করেছেন। এমনকি তিনি ২০১৮ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইআরসি আরবান ইকোলজিস প্রকল্পে ভিজিটিং স্কলার হিসেবে অংশগ্রহণ করেছিলেন আমরা দিল্লীর এবং দেশ বিদেশের প্রায় সকল বাঙালিরাই শ্রী সেনের গর্বে গর্বিত।
অতএব, তিনি বিশেষভাবে সবাইকে তাঁর চলচ্চিত্র টি দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। “আপনাদের সকলকে বিশেষ ভাবে অনুরোধ, আপনারা অবশ্যই এই উৎসবে উপস্থিত হয়ে, দিল্লী শহরের এক বাঙালি ছেলে, আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন শৌনক সেনের সৃষ্টিশীল কাজকে প্রত্যক্ষ করুন। নিঃশুল্ক প্রবেশের এই উৎসবের এর আগে প্রথম দিন সকালে, সর্বপ্রথম যে ছবিটা দেখানো হবে সেটা কলকাতার বিলুপ্তপ্রায় ভিস্তিওয়ালাদের নিয়ে প্রথম তথ্যচিত্র ‘ওয়াটারওয়ালা’ (Water Wala) যেটির পরিচালক হলেন, আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত চিত্র পরিচালক রাজাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়। ভারত ও ফিনল্যান্ডের যৌথ প্রযোজনায় তৈরি এই ছবিটি, কলকাতার বিলুপ্তপ্রায় পেশার মানুষ যাঁরা বিশেষ চামড়ার ব্যাগে করে, অতীতে সমগ্র কলকাতা জুড়ে জল সরবরাহ করতেন, সেই ভিস্তিওয়ালারাদের জীবনকাহিনী, তাঁদের অবদান সেলুলয়েডে মুড়ে, সযত্নে তুলে ধরেছেন। দীর্ঘ পরিশ্রমের ফসল হিসাবে, এই অনন্য গবেষণামূলক ছবিটি, দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বহু আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বারবার প্রদর্শিত হয়ে, অসংখ্য মানুষকে মুগ্ধ করেছে বারেবার। এই বহুল চর্চিত ছবিটি এই প্রথমবার, রাজধানী দিল্লি শহরে প্রদর্শিত হবে দিল্লির বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশনের হাত ধরে। কলকাতার মধ্যে অচেনা কলকাতাকে জানতে, নতুন করে চিনতে, প্রদীপ গাঙ্গুলি সকলকে আমন্ত্রণ জানান।
তিনি এই প্রতিবেদককে উৎসবের বাড়তি আকর্ষণ সম্পর্কে অবহিত করেন। “পরিশেষে বলি, যেকোনো আনন্দ আয়োজনে, রসনা তৃপ্তি না হলে, উৎসব ঠিক মতো প্রাণ পায় না, ঠিকমতো জমে ওঠে না। এরই লক্ষ্যে, দুদিন ব্যাপী বিশেষ আকর্ষণ হিসাবে পালিত হবে, ‘পদ্মা-যমুনা খাদ্যোৎসব। অর্থাৎ দুই বাংলার মুখরোচক এবং ঐতিহ্যবাহী খাদ্যের সম্ভার নিয়ে, হাজির থাকবেন রন্ধনপটু বাবুর্চিরা। যেখানে সকলেই, ন্যাযযমূল্যে কিনে নিতে পারবেন, পছন্দমতো খাবার। জানি দেখা হবে, নিশ্চয়ই দেখা হবে সকলের সাথে, কারণ ভালবাসার মিলন যে অবধারিত।”