Women on the long road- Representational image
Share it

কবিতা মুখোপাধ্যায় (শিক্ষাবিদ) : আর কত পথ হাঁটলে পাব সাম্যের অধিকার ? ১৮২০ থেকে ২০২১। এই দীর্ঘ সময় ধরে চলছে প্রয়াস – ‘নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবারে কেন নাহি দেবে অধিকার…’। এই অধিকার অর্জনে যে মানুষগুলি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত লড়াই করেছিলেন তাঁদের অন্যতম প্রধান পুরুহিত ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, যাঁর জন্ম হয়েছিল ১৮২০, ২৬ সেপ্টেম্বর এবং প্রয়াণ হয় ১৮৯৯, ২৯ জুলাই। ২০১ বছর পূর্ণ হয়েছে তাঁর জন্ম, কিন্তু এই দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেও এ দেশের নারীদের অবস্থান কি খুব উজ্জ্বল ?

আজও মেয়েদের লেখাপড়া যাতে বাল্যেই শেষ না হয়ে যায়, যাতে নাবালিকার বিয়ে না হয়ে যায়, তার জন্য প্রয়োজন হচ্ছে ‘কন্যাশ্রী’র মত প্রকল্পের। যাতে মেয়েরা পড়া বন্ধ না করে এগিয়ে যেতে পারে, যাতে নাবালিকা মেয়েদের বিয়ে না হয়ে যায় তার জন্য স্বাধীনতার পর থেকে অনেক পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও স্বাধীনতার ৭৫ বছরে এসেও ‘কন্যাশ্রী’ ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’-এর মত পরিকল্পনা চালু রাখতে হচ্ছে যা একান্তই লজ্জার।

বিধবা বিবাহ প্রচলনের জন্য বিদ্যাসাগর করেছিলেন দীর্ঘ সংগ্রাম। এখন সমাজে বিধবা বিবাহ কোন বিশেষ ঘটনা নয়। কিন্তু আমরা কি স্ব-ইচ্ছায় কোন বিধবা মেয়েকে বাড়ির বউ হিসেবে গ্রহণ করব ? আজও নারীর প্রধান অস্তিত্ব সংসারের মাঝে বলেই বিবেচিত। এখনও কোন শিক্ষিতা কর্মরতা মেয়ে যদি তার বিবাহিত জীবনকে নিজের উন্নতির অন্তরায় বলে মনে করে এবং বিবাহ বিচ্ছেদ চায় তবে সে কিন্তু সহজে সে মুক্তি পাবে না। তার সমাজ তাকে তীর্যক বাক্যে বিদ্ধ করবে শুধু নয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার বাপের বাড়ি থেকে সমর্থন পাবে না।

বিদ্যাসাগর মেয়েদের শৃঙ্খল মোচনে যে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিলেন সে তিনটি হল নারী শিক্ষার প্রসার, বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ এবং বিধবা বিবাহ প্রচলন। এ বিষয়ে তাঁর ভাবনা ছিল, “এতদ্দেশে যদ্যপি স্ত্রী জাতির বিদ্যা শিক্ষার প্রথা প্রচলিত থাকিত, তবে অস্মদেশীয় বালক-বালিকারা মাতৃসন্নিধান হইতেও সদুপদেশ পাইয়া অল্প বয়সেই কৃতবিদ্যা হইতে পারি।” আসলে একজন মা যেভাবে তার সন্তানের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে সেটা অন্য কারও পক্ষে সম্ভব নয়। জন্মলগ্ন থেকে একটি সন্তান সম্পূর্ণভাবে থাকে মায়ের নিয়ন্ত্রণেই, তাই সুস্থ সমাজ গঠনে বিদ্যাসাগরের ভাবনা ছিল বাংলার ঘরে ঘরে মায়েরা শিক্ষিত হোক এবং এই লক্ষ্যেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বহু বালিকা বিদ্যালয়। তথ্য থেকে জানা যায় ১৮৫৮ সালের জানুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যেই হুগলি জেলায় ১৩টি, বর্ধমানের ১০টি এবং মেদিনীপুরে ৩টে বিদ্যালয় স্থাপন করেন।

তিনি চেয়েছিলেন বালিকারা যদি স্কুলে যাবার অভ্যাস রপ্ত করতে পারে তবে বাল্যবিবাহ রোধ অনেকটা সহজতর হবে। তিনি এও মনে করতেন যে, অতি অল্প বয়সে যে মেয়েরা বিধবা হয়ে যায় তার পিছনে অন্যতম কারণ বাল্যবিবাহ এবং পুরুষের ক্ষেত্রে বিবাহের কোন ঊর্ধ্বসীমা না থাকা। বিশেষত কুলীন ব্রাহ্মণদের ক্ষেত্রে ভীষণভাবে এটা ঘটত।

এটা আমাদের পক্ষে লজ্জার যে এত বছর পার হয়ে এসেও আমরা সম্পূর্ণভাবে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করতে পারিনি। তাই ‘কন্যাশ্রী ক্লাব’ তৈরি করে মেয়েদেরই উদ্যোগী করে তোলা হচ্ছে নাবালিকা বিয়ে রোধ করতে। এবং এমনই অতিমারির কল্যাণে বন্ধ স্কুল-কলেজের সুযোগে ‘কন্যাশ্রী ক্লাবের’ কিছুটা নিষ্ক্রিয়তা, বর্ধিত করেছে নাবালিকা বিয়ে, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে এখনও সমাজে চলছে নাবালিকা বিয়ে, কন্যাভ্রূণ হত্যার মত ঘটনা। বিদ্যাসাগর যখন বিধবা বিবাহ প্রচলনের লড়াইয়ে নেমেছিলেন তখন তিনি হাতিয়ার করেছিলেন হিন্দু ধর্মশাস্ত্রকেই। তিনি বিধবা বিবাহের সপক্ষে তুলে ধরলেন পরাশর সংহিতা – “নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে, ক্লীবে চ পতিতে পতৌ” অর্থাৎ স্বামী মারা গেলে বা নিরুদ্দেশ হলে, ক্লীব স্থির হলে, সংসার ধর্ম ত্যাগ করলে অথবা পতিত হলে তাদের স্ত্রীরা পুনরায় বিবাহ করতে পারেন। ধর্মের অস্ত্র দিয়েই ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের 26 জুলাই বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠা করলেন বিধবা বিবাহ-কে। কিন্তু বর্তমানে ধর্মকে অস্ত্র করে সমাজ হিতকর কোন কাজ হতে দেখা যায় না, বরং ধর্মকে ব্যবহার করে প্রতি নিয়ত ঘটানো হচ্ছে এমন সব ঘটনা যা কখনই কোন সুস্থ ধর্ম বোধ সমর্থন করে না।

সতীদাহ প্রথা, বিধবা বিবাহ, নারী শিক্ষার ব্যবস্থা চলেছে সেই রামমোহন থেকে আজ ‘কন্যাশ্রী’র মাধ্যমে কিন্তু সত্যিই কি নারী পেয়েছে সাম্যের অধিকার ? নিজের শরীর-মনের উপর, স্বাধীন চলাফেরার ক্ষেত্রে, কর্মক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা, একজন যা একজন পুরুষ উপভোগ করে থাকে। অবশ্য ব্যতিক্রমী নারী নিশ্চয়ই আছেন, কিন্তু ব্যতিক্রমীরা সমাজের উদাহরণ, সমাজ নন। তাই আজও দূরদর্শনের পর্দায় উঠে আসে বাল্য বিবাহ বন্ধ করার বিজ্ঞাপন, যা হত সমাজেরই চিত্র। সংখ্যাগরিষ্ঠ মেয়েরা সংসারের সীমানায় এমন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকেন যে চাকরির উন্নতি ও অনেক সময় গ্রহণযোগ্য হয় না। সংসারের দায়দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক সময় তাঁরা উপেক্ষা করেন নিজেকেই, নিজের গুণাবলীকেই।

প্রচলিত একটা প্রবাদ আছে ‘সংসার সুখের হয় রমনীর গুণে’ – কিন্তু সেই রমণীর গুণগুলিই যদি উপেক্ষিত, অচর্চিত থেকে যায় তাকে প্রকাশ করতে না দিই তবে সংসারে, সমাজে সুখ বা উন্নতি ঘটবে কিভাবে? বিদ্যাসাগরের জন্মের ২০১ বছরে পৌঁছেও যদি আজও ‘নারী’ থেকে যায় আলোচনার বিষয় হিসেবে, আজও যদি নারী প্রথমে মানুষ, পরে নারী এই চেতনা প্রস্ফুটিত না হয়ে থাকে, আজও যদি প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত ৫ থেকে ৭৫ সব নারীকেই ধর্ষিত হতে হয় তবে কি আমরা পারব রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথের মত প্রাতঃস্মরণীয়দের যথাযথ সম্মান দিতে ? আর পারব কি দিতে দেবী শক্তি পূজারী রাজ্যের মায়েরা ‘মানুষ’ হিসেবে তাদের যথাযথ সম্মান ? ২০১ বছর সময়টা কিন্তু কম নয়, নারী যদি অর্ধেক আকাশ হয়ে থাকে তাহলে তাকে যথাযথ সাম্য ও স্বাধীনতার অধিকার দিতে হয় নতুবা অগ্রগতি কখনই সম্ভব হবে না। পশ্চাতে ফেলিছ যারে, সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে… এগোনো যাবে না।

Share it