নিউজ ওয়েভ ইন্ডিয়া: অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মাকে অনেকেই ‘মামু’ বলেন সম্বোধন করে থাকেন এবং তাতে মুখ্যমন্ত্রী বেশ খুশি বলেই মনে হয়। অসমের কোনও কোনও মিডিয়া তাঁকে ‘বাকপটু’ ও ‘তুখোড়’ বলে উল্লেখ করে থাকেন। সেই হিমন্তবাবু হঠাৎ একটি চূড়ান্ত কথা বলে ফেলেছেন। তিনি জানিয়েছেন নাগরিকত্বের ফর্মে যিনি নিজেকে বাংলাভাষী বলে উল্লেখ করবেন ধরে নেওয়া হবে তিনি বাংলাদেশি এবং তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে বিদেশী বলে চিহ্নিত করে দেওয়া হবে। বাকপটু ‘মামা’ অবশ্য নানা সমালোচনার চাপে পড়ে রাতারাতি সেই বক্তব্য পালটে ফেলেছেন এবং বলেছেন অমন কথা তিনি বলতে চাননি। আসলে অসমে বাংলাদেশীদের চিহ্নিত করার জন্য অসম সরকার খুবই তৎপর আর সে কারণে মোটামোটিভাবে সব বাংলাদেশিকেই এবং তাদের ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হবে অর্থাৎ তাঁরা আর নাগরিক থাকতে পারবেন না।
তবে নাগরিকত্ব ব্যাপারটি নির্ধারণ করার কথা মূলত কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের। কিন্তু হিমন্তবাবু যেহেতু ওই রাজ্যে বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী (Assam CM) এবং দলের নেতা হিসেবে গণ্য হয়ে থাকেন তাই তাঁর এইসব কথাবার্তার ওজনও আছে বলে ধরে নিতে হবে।
শুধু কথায় নয়, কাজেও নেমে পড়েছেন হিমন্তবাবু (Himanta Biswa Sarma)। গত ১৩ জুলাই থেকে নমোনি ও মধ্য অসমের বিভিন্ন জায়গায় গরিবগুর্বো মানুষজনের যেসব ঝুপড়ি ও বসতি আছে তা উচ্ছেদ কর দেওয়া হচ্ছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সেখানকার মানুষজন তলপিতলপা ও পুটলি নিয়ে অন্য জায়গায় সরে যাচ্ছেন কোথায় যাচ্ছেন তা নিয়ে অবশ্য রাজ্য প্রশাসন বা সরকারের কোনও মাথাব্যথা নেই। এর কারণ এইসব গরিবগুর্বো মানুষজনের অধিকাংশই বাংলাভাষী। তাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছেন হিমন্তবাবু এবং তাঁর লোকজন। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে এই কাজে সরাসরি অংশ নিয়েছে বিজেপি। কোনও রাজনৈতিক দল হিসেবে এবং উৎখাত করে বিশেষ একটি সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা। সাধারণভাবে এইসব কাজ করার কথা প্রশাসনের কিন্তু এখানে রাজনৈতিক দল সেকাজে নেমে পড়ে কী বার্তা দিতে চাইছে তা পরিষ্কার নয়।
হিমন্তবাবু এবং তাঁর লোকজন এই প্রক্রিয়াকে ‘লেন্ড জিহাদ’ বলে ঘোষণা করেছেন। যদিও মুখ্যমন্ত্রী নিজেই বলেছেন এটা কেবল ‘লেন্ড জিহাদ’ নয়। এটা আসলে ওদের ‘ফিনিজ অসম জিহাদ’। ওদের এই চেষ্টা রুখে দিতে হবে। আর সেই কারণেই বিজেপি প্রায় হাজার খানের লোক নিয়ে মিছিল বের করেছে এবং উৎখাত হওয়া মানুষজনকে তাড়া করে এলাকাছাড়া করেছে। তেজপুর নওগাঁ প্রভৃতি শিবসাগর জেলার বহু এলাকাতেই এই ছবি দেখা গেছে গত ১৪ ও ১৫ জুলাই।
এই উল্লাসের কারণ কী ? আসলে অসম চিরকালই বাঙালি অধ্যুষিত। বিশেষ করে কাছাড়, গোয়ালপাড়া, শিবসাগর জেলার বহু এলাকায় বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। উজানি অসমেও বাঙালিরা বহু জায়গায় সংখ্যা গরিষ্ঠ। এই অসমে অসমীয়া ভাষীরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে পরিণত হতে পারেন এই দুশ্চিন্তা সবসময়ই রয়েছে। এর একটা ইতিহাসও আছে, সেই ইতিহাস ব্রিটিশ আমল থেকেই। ব্রিটিশ শাসকরা তখনকার বাংলা, বিশেষ করে পূর্ববঙ্গ থেকে বহু বাঙালিকে অসমে নিয়ে গিয়ে বসায়। তাই অসমীয়ায় বা অসমে বসবাসকারী বাঙালিদের একটা বড় অংশই মুসলিম সম্প্রদায়ের সেখানে গিয়ে তারা চাষবাস করে শস্য উৎপাদনে অসমকে সমৃদ্ধ করে তুলেছিলেন। তারপর থেকে বংশপরম্পরায় তাদেরকে সেখানেই থেকে যেতে হয়েছে। তাই সকলকে বাংলাদেশী বলা বাস্তবসম্মত নয়। হিমন্তবাবু এরপর উজানি অসমেও বুলডোজার চালানোর কথা দিয়েছেন। অর্থাৎ সেখান থেকেও বাংলাভাষীদের তাড়ানোর চেষ্টা হবে এবং তাদেরকে বাংলাদেশী বলেও দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হবে কিন্তু সে হবে ঘোরোতর অন্যায়।
এই যে ভয় পাওয়ার মতো বাংলাদেশীদের সংখ্যা বৃদ্ধি এটা কেমন করে সম্ভব হল? আসলে বহুদিন ধরে বসবাসকারী বাঙালিদেরই বাংলাদেশী বলে মেনে নিলে কেন্দ্রের ব্যর্থতাই প্রমাণিত হয়। বাংলাদেশ থেকে কোনও অনুপ্রবেশ হচ্ছে কিনা তা দেখার দায়িত্ব কেন্দ্রের। তার জন্য বিএসএফ এবং অন্যান্য সুরক্ষা বাহিনী রয়েছে তা সত্ত্বেও কী করে এত লোক ঢুকছে, এটা কি সম্ভব। সংখ্যালঘু হয়ে পড়ার ভয় থেকে এর আগেও অসমে বঙ্গাল খেদাও আন্দোলন হয়েছে। সেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে অসম গণ পরিষদ রাজ্যের ক্ষমতাও দখল করে এবং আন্দোলনের নেতা প্রফুল্ল মোহান্তি মন্ত্রীও হন। সেসময় বহু বাঙালিকে ওই রাজ্য ছাড়তে বাধ্যও করা হয়েছিল। তাতেও ভয় কমেনি। তাছাড়া ওই সময় নেলি নামে একটি জায়গায় আগুন লাগিয়ে দিয়ে সমস্ত বাঙালি বসবাসকারীকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। তবে সেসময়ে সেখানে কোনও পুরুষ ছিলেন না তাঁরা কাজে চলে গিয়েছিলেন কেবল ছিলেন বৃদ্ধ বৃদ্ধারা, মহিলারা এবং বালক ও শিশুরা। সেই ঘটনার কোনও ফয়সালা এখনও হয়নি। ফলে একথা বলাই যায় সংখ্যালঘু হওয়ার ভয় থেকে অসমীয়াবাসীদের একটা অংশ বাঙালিদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালিয়ে আসছে হিমন্ত বিশ্বশর্মার এখনকার আচরণ তাই নতুন কিছু নয়। কেবল নতুন হচ্ছে সেটাই যে এর সঙ্গে যোগ দিয়েছে বিজেপি (BJP) নামে একটি রাজনৈতিক দল। তারা অবশ্য বলছে বাঙালিদের এই ব্যাপক সংখ্যাবৃদ্ধি নাকি কংগ্রেসের চক্রান্ত। তার মানে বাঙালিদেরকে কেন্দ্র করে বিজেপি পরিষ্কার রাজনৈতিক খেলায় নেমেছে। এবং এব্যাপারে তার প্রধান প্রতিপক্ষকে টার্গেট করেছে। অদূর ভবিষ্যতে কী ঘটবে তা অসমের ভাগ্যবিধাতাই জানেন।