‘উড়ন্ত শিখ’ মিলখা সিংয়ের জীবনাবসান হয়েছে শুক্রবার রাতে। কিংবদন্তি এই দৌড়বিদকে নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন লিখেছেন সাংবাদিক জয় ভট্টাচার্য।
শনিবার 19 জুন 2021। এই তারিখ টা ভারতবাসীর কাছে আর একটা কালো দিন। এই দিন ভোরবেলায় করোনার কাছে দীর্ঘ লড়াইয়ে হেরে গিয়ে চিরঘুমের দেশে পাড়ি দিলেন ভারতের প্রাক্তন কিংবদন্তি দৌড়বিদ মিলখা সিং।
আজ থেকে মাত্র পাঁচ দিন আগে মিলখা সিংয়ের সহধর্মিনী নির্মলা কাপুরের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল মারণ ভাইরাস কোভিড 19। 2020 সাল থেকে একের পর এক নক্ষত্রের পতন ঘটে চলেছে। যা অব্যাহত 2021-এর মাঝামাঝিতে।
মিলখা সিংয়ের জন্ম 1929 সালের 20 নভেম্বর। বর্তমান পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের গোবিন্দপুর গ্রামে। তাঁরা মোট 15জন ভাইবোন ছিলেন। ভারতবর্ষ তখনও স্বাধীন হয়নি। হঠাৎই পাক সেনাদের হিংস্র আক্রমণ নেমে এসেছিল গোবিন্দপুর গ্রামের এই শিখ পরিবারটিতে। ছোট্ট মিলখা চোখের সামনে দেখেছিল তাঁর বাবা মা ও আট ভাইবোনকে তারা কী নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। মৃত্যুর অসহনীয় যন্ত্রনায় কাতরাতে কাতরাতে ছোট্ট মিলখার বাবা সেদিন চিৎকার করে বলছিলেন ভাগ মিলখা ভাগ। উনলোক তো রে কোডি মার দে গা। হ্যাঁ, মিলখা বেঁচে গিয়েছিল সেদিনের সেই নারকীয় হত্যাকাণ্ড থেকে।
এরপর আর পাকিস্তান নয়, ছোট্ট মিলখার ঠিকানা হয়েছিল ভারতের পঞ্চনদের মাটিতে তাঁর দিদির কাছে। বাবা মা ভাই বোনদের এইভাবে খুন হতে দেখে সেই সময় সমাজের মূল স্রোত থেকে কিছুটা হারিয়ে যেতে শুরু করছিল সেদিনের মিলখা। একবার বিনা টিকিটে ট্রেনে চড়ার অপরাধে তাঁর ঠিকানা হয়েছিল তিহার জেলের তিন ফুট বাই তিনফুটের ছোট্ট কুঠুরিটিও। না জেল ফেরত হলেও মিলখা সিং হয়ে ওঠৈনি কোনো দাগী অপরাধী। বরং ভারতমাতার বীর সন্তান হিসেবে সে সারা বিশ্বের মানুষের কাছে উড্ডীন করেছিল আমাদের ত্রিবর্ণ রঞ্জিত জাতীয় পতাকা। সেলুট মিলখা সিং তোমায়।
তিহার জেল থেকে বাইরে এসে নিজেকে সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনতে উঠেপড়ে লাগে মিলখা। ঠিক করে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেবেন। সালটা 1949। না ব্যর্থ হলেন। পরের বছর আবার চেষ্টা। সেবারেও ব্যর্থ। অবশেষে 1952 সালে সফল হয়ে যোগ দিলেন সেনাবাহিনীতে। মাইনে 39 টাকা 8 আনা। ভাগের চাক্কা এখান থেকেই ঘুরতে শুরু করেছিল এই শিখ তরুণের।
সেনাবাহিনীতে মিলখা সিং দৌড় নজর কেড়ছিল সেনা কর্তাদের। অবশেষে মিললো জাতীয় দলের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াক্ষেত্রে মাঠে নামার সুযোগ। 1956 সাল। মেলবোর্ন অলিম্পিক। 200 ও 400 মিটার দৌড়ে ভারতের প্রতিনিধি মিলখা সিং। জীবনের প্রথম বড় প্রতিযোগিতা। কিন্তু আশা থাকলেও নিরাশ করলেন মিলখা। সেদিনের সেই খারাপ ফলে ভেঙে পড়েননি সেনাবাহিনীর এই জওয়ান। বরঞ্চ এখান থেকেই শিক্ষা নিয়েছিলেন কিভাবে পরবর্তীকালে সাফল্য অর্জন করা যায়।
সাল 1958 ভারতের কটকে বসল জাতীয় গেমসের আসর। রোম অলিম্পিকের ব্যর্থতাকে দূরে সরিয়ে এগিয়ে চললেন মিলখা। 200 ও 400 মিটারে জিতলেন সোনা। ওই বছরই কমনওয়েলথ গেমস এ হলেন প্রথম। দুর্গম এভারেস্টের পথ অতিক্রম করে এখানে সাফল্যের শিখরে উঠতে শুরু করলেন মিলখা সিং। নিজের ইভেন্টে পরাজিত করেছিলেন সেই সময় পাকিস্তানের বিখ্যাত দৌড়বিদ আব্দুল খালিকে। যা মন থেকে মেনে নিতে পারেননি পাকিস্তানের জনগণ। কিন্তু বাবা মা ভাই বোনদের হত্যাকারীদের উপর সেই প্রতিশোধ নিয়ে নিয়েছিলেন মিলখা।
এই হারের প্রতিশোধ নিতে 1960 সালে একটি স্পোর্টস মিটের আয়োজন করে পাকিস্তান। লাহোরে অনুষ্ঠিত সেই প্রতিযোগিতায় ডাক পড়ে মিলখারও। প্রথমে রাজি না হলেও প্রধানমন্ত্রী নেহরুর অনুরোধে সেই প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। খোদ পাকিস্তানের মাটিতেই খালিককে আবার হারিয়ে মিলখা প্রমাণ করেছিলেন মা বাবা ভাই বোনদের হত্যাকারীদের প্রতিশোধ তিনি এভাবেই নেবেন। তাঁর এই পারফরম্যান্সের গ্রাফ দেখে তৎকালীন পাক প্রেসিডেন্ট আয়ুব তাঁর নাম দিয়েছিলেন ‘দ্য ফ্লাইং বার্ড’।
এরপর 1960 সালের ঐতিহাসিক রোম অলিম্পিকের আসরে অল্পের জন্য ব্রোঞ্জ হাতছাড়া হলেও সেই দুঃখ মিটিয়ে নিয়েছিলেন 1962 সাল ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় এশিয়ান গেমসের আসরে। সেখানে পেলেন দুটি সোনা। পারফরম্যান্স থাকতে থাকতেই 1964 সালে বিদায় নিলেন তাঁর প্রিয় ট্র্যাক থেকে।
ভারত সরকার কিংবদন্তী এই দৌড়বিদকে পদ্মশ্রী ও অর্জুন সম্মানে ভূষিত করেছে। কিন্তু করোনা তাঁকে ছিনিয়ে নিয়েছে আমাদের কাছ থেকে। ভাগ মিলখা ভাগ। এখন থেকে শুধুই বায়োপিক। আর জীবন্ত নয়। পরলোকে ভালো থাকবেন ‘দ্য ফ্লাইং বার্ড’।