Share it

ততদিনে ‘চরাচর’ মুক্তি পেয়ে গেছে…তা প্রায় বছর তিনেক হবে…দর্শকের মনে সে ছবি নিয়ে উত্তেজনাও স্তিমিত…ব্যবসা তেমন হয়নি…তাই সামনে না হলেও আড়ালে-আবডালে ইন্ডাস্ট্রির মেইনস্ট্রিম শাখার লোকজন বলাবলি করেন ছবিটায় নাকি “কিস্যু নেই”…কেবল “পাখি ধরা আর পাখি ছাড়া”…”ওসব ছবি দেখতে গাঁটেরকড়ি খরচা করে পাবলিক হলে যায় কখনো…?” এজাতীয় ফিল্মে প্রোডিউসারের পয়সা ঢালাই নাকি “বেকার…”

এতসব দেখে-শুনে-জেনে দিনদিন আমিও কেমন যেন দ্বিধাগ্রস্ত…বিচলিত…

সেদিন দুপুরে ‘নন্দন’ অডিটোরিয়ামের তিনতলার শীততাপনিয়ন্ত্রিত প্রেক্ষাগৃহে আমরা একদল ছাত্রছাত্রী সারিবদ্ধ ভাবে বসে আছি…’ফিল্ম এপ্রিসিয়েশন’ ক্লাস চলছে…পঞ্চাশোর্ধ এক ‘যুবক’ সশরীরে শিক্ষক-বক্তা হিসেবে স্টেজে বসে ক্লাস নিচ্ছেন…ফিল্মের বিশেষ খুঁটিনাটি শেখাচ্ছেন জানাচ্ছেন…আপন ভঙ্গিমায় হাত নেড়ে নেড়ে তিনি বোঝাচ্ছেন সিনেমার শিল্প-আঙ্গিক…দেশবিদেশের বিখ্যাত ছবির পাশাপাশি বারেবারেই উঠে আসছে তাঁর নিজের ছবির কথাও…শোনাচ্ছেন সেসব ছবি বানানোর কথা…

যতই শুনছি ততই যেন আমার ভেতরে ভেতরে একটা বিশেষ ‘উত্তেজনা’ কাজ করছে…মনের মধ্যে অবিরাম দোলাচল…
হঠাৎ করেই আমার মুখ থেকে তাঁর দিকে ধেয়ে গেল এতক্ষণ ধরে জমে থাকা সেই অমোঘ প্রশ্নবাণ :

“তাহলে আপনি কি বলতে চাইছেন সাধারণের প্রতি একজন শিল্পীর কোনও দায়বদ্ধতা থাকবে না…?”

আচমকা এমন প্রশ্নে গোটা হলঘর পুরোপুরি স্তব্ধ…নিশ্চুপ…সাময়িক স্তব্ধতা কাটিয়ে নিজের যাবতীয় বিরক্তিকে সংযমে রেখে তিনি বলতে শুরু করলেন তাঁর সেই বিখ্যাত ‘ম্যাজিক রিয়েলিজম’…জ্ঞানগর্ভ কথনে ধরে ধরে বোঝাতে লাগলেন সিনেমার ভাষা কী…কীভাবে সুক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম শৈল্পিকছোঁয়ায় তাকে ফুটিয়ে তুলতে হয় চিত্রে-কাব্যে-গল্পে…সমগ্র চিত্রমালায়…

এদিকে যৌবনের ঔদ্ধত্যে আমিও বজ্জাত-ত‍্যাঁদোড়…নাছোড়বান্দা…বাজারী কথাগুলো মনের মধ্যে গিজগিজ করছে তখনও…তাই আবারও অপ্রিয়-নির্বোধ কিছু প্রশ্নে ঝাঁঝরা করতে চাই তাঁকে…তাঁর শিল্পীসত্ত্বাকে :

“আচ্ছা আপনাদের মত প্রখ্যাত শিল্পীদেরও কি দায়িত্ব নয় ‘শিল্প’কে বোঝার মত উপযুক্ত দর্শক বা শ্রোতা তৈরি করে যাওয়া…? কিংবা নিদেনপক্ষে তাঁদের বোধমাত্রা অনুযায়ী শিল্পসৃষ্টি…? অন্তত পরোক্ষভাবে ধীরে ধীরে তাঁদেরকে ‘শিক্ষিত’ তো করাই যায়…নাহলে শিল্পের সার্থকতা কোথায়…? কীভাবে হবে তাহলে শিল্পের সার্বিক বিস্তার…? কীভাবেই বা ‘উন্নত’ হবে সাধারণের শিল্পরুচি বোধ ও চেতনা…?”

শিষ্টাচার ভেঙে একদমে বলে যাই কত কথা…একপ্রকার বিদ্ধ করি তাঁকে কিছু বলতে না দিয়েই…

ততক্ষণে তাঁর ফর্সামুখ ক্রোধ-বিরক্তির উত্তেজনায় আরক্ত…দূর থেকেই মালুম হচ্ছে বিন্দুবিন্দু ঘাম এসে জমেছে তাঁর নাকে-কপালে…গোটা মুখমণ্ডলে…খানিক চুপ করে থেকে হাত নেড়ে কাছে ডাকলেন আমায়…পরিস্থিতি মন্দ আঁচ করে হলের পিছনের সিট ছেড়ে দ্বিধাগ্রস্থ পায়ে হেঁটে সামনে ডায়াসের দিকে এগোই…বুকে ভয়ের দুরুদুরু…কাছে যেতেই পাশে ডেকে নিয়ে শোনালেন তাঁর সেই অ-রূপ ভাবনা ও চেতনার কথা :

“আমি একজন শিল্পী…আমি আমার মত করেই আঁকি-লিখি সিনেমা বানাই…রূপ দিই আমার ভাবনাকে…সেটা কেউ দেখল কি দেখল না বুঝল কি বুঝল না…আমার কী এসে যায় তাতে…? আমার কাজের মধ্যে দিয়ে আমি আমার ভাব প্রকাশ করতে পারি মাত্ৰ…সেটা তুমি বুঝতে পারলে ভাল আবার না বুঝলেও কোনও ক্ষতি নেই…আমি আসলে আমার কল্পনার সুতোগুলোকে নিয়ে কার্পেট বুনি…বুনতে চেষ্টা করি…
তোমার মনে হলে তুমি দেখবে না…শুনবে না…পড়বে না…এমনকি তোমার মনে হলে এখনই তুমি এই হলঘর ছেড়ে চলে যেতে পার…আমি আটকাব না…”

বিহ্বল দৃষ্টিতে মন্ত্রমুগ্ধের মত ওঁর কথা শুনি…শুনে যাই…কথা শেষ হলে মাথা নিচু করে ওঁকে প্রণাম করে মন্থরপায়ে নিজের আসনে ফিরি…তাৎক্ষণিক ‘অভিমান-অপমানে’ ওঁর অটোগ্রাফ নেওয়াই মুলতুবি হয়ে যায়…বেশ মনে আছে উনিও আলোচনা শেষে বেরোবার সময় একবার ফিরে আমার দিকে তাকিয়েছিলেন…সে দৃষ্টিতে মিশেছিল গাঢ় করুণার আবেশ…

সেটা মার্চ ১৯৯৬…সেটা আমার কাছে এক অমূল্য স্মৃতিরতন…আজ ‘সময়ের কাছে’ তাই আমার এই অকপট শ্রদ্ধাস্মরণ…তিনি বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত (Buddhadeb Dasgupta)…তিনি একাধারে কবি ও চিত্রপরিচালক…অনেকের মত আমার কাছেও তিনি বরাবর একজন ব্যতিক্রমী ‘শিল্পী’…

স্যার আপনি খুব ভাল থাকুন…আমার মত আর কোনো অবোধ আর কখনো আপনাকে অমন অন্তঃসারশূন্য নির্বোধ প্রশ্নে জ্বালাতন করবে না…এবার আপনি মনের সুখে ওপারে আসমানী রঙে ‘স্বপ্নের দিন’ রচনা করুন ‘কালপুরুষ’ সেজে…নীচের এই ‘দূরত্ব’ থেকে আমরা ঠিক তা টের পাব… বিশ্বাস রাখি অজ্ঞানতার এই ‘অন্ধী গলি’ থেকে ‘উত্তরা’পর্বে একদিন না একদিন সকলের ‘মুক্তি’ ঘটবেই…।

*( বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : ১৯৪৪ – ২০২১ )

Share it