জয়া চৌধুরী
Share it

জীবনে চড়াই উতরাই থাকে। লীলা রায় পুরস্কার প্রাপক জয়া চৌধুরীর ক্ষেত্রেও তাই। কিন্তু, অসফল দাম্পত্যের লড়াইয়ে জয় লাভ করে যেভাবে বিদেশি অনুবাদ সাহিত্যে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন তিনি, সেই জীবনকাহিনি যে কোনও নারীকে প্রেরণা জোগাবে। ভাষা সাহিত্য অনুবাদে নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে লীলা রায় সম্মান আদায় করে নিয়েছেন। তাঁর সঙ্গেই কথা বলেছিল নিউজ ওয়েভ ইন্ডিয়া। পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎকার প্রকাশ করা হল আমাদের ওয়েব পাঠকদের জন্য।

১) লীলা রায় পুরস্কারই কি এখনও পর্যন্ত জীবনের সেরা প্রাপ্তি ? নাকি এরপরও কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা রয়েছে, যা পাওয়ার লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছেন?

জয়া চৌধুরী (ফাইল ফোটো)
জয়া চৌধুরী (ফাইল ফোটো)

লীলা রায় পুরস্কার (Lila Roy Award) প্রাপ্তিটা আমার মন ভালো করে দিয়েছে অবশ্যই। সত্যি কথা বলতে কী এখন মানুষের তো এত খুঁটিয়ে দেখা বা পড়ার সময় নেই। একটা সরকারি পুরস্কার হলে মানুষ তার আগের প্রশ্নগুলো করে না যোগ্যতা নিয়ে। সেই হিসেবে একটা ব্যবহারিক লাভ হয়েছে ঠিকই। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী সেরা প্রাপ্তি হচ্ছে মনের মতো একটা কাজ করে যাওয়া অনুবাদে (Translation), যাতে আমি না থাকলে সেই কাজটি কিছু অবদান রাখবে বাংলা অনুবাদ সাহিত্যে (Bengali Literature)। সেই হিসেবে অপ্রাপ্তিই এখনও আছে। আর এরপরেও কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা প্রধানত আমার অনুবাদ করে তৃপ্তি পাওয়ার দিকেই থাকে। সেটা বোধহয় কখনওই এই তৃপ্তিটা হবে না। কারণ স্প্যানিশ সাহিত্যে (Spanish Literature) জগতে ঢুকে আমি বুঝতে পারছি যে এত বিপুল সম্ভার এতগুলো দেশ এত বড় বড় কাজ হয়েছে যে এটা এক জীবনে করে পারা যাবে না। তবুও আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি যাতে বেশ কিছু ভালো সাহিত্য কীর্তি এবং বেশ কিছু মহান লেখক যাঁদের নাম বাংলা ভাষায় খুব আলোচিত নয় কিন্তু তাঁরা খুব বেশি ইংরেজিতে অনুদিত নন অথচ স্প্যানিশ দুনিয়ায় একেবারে সম্রাটের মতো জায়গাগুলো রেখে দিয়েছেন। তো সম্পূর্ণ অজানা সেই সব মহৎ লেখকদের বাংলা সাহিত্যে নিয়ে আসার চেষ্টা করি প্রতিদিন।

২) লীলা রায় পুরস্কার পাওয়া পর্যন্ত আপনার জীবনের লড়াই সম্পর্কে কিছু বলুন।

জয়া চৌধুরী (ফাইল ফোটো)
জয়া চৌধুরী (ফাইল ফোটো)

জীবনের লড়াই শব্দটা হয়তো আমাদের মতো মানুষদের বলা মানায় না। কারণ আমি তাকিয়ে দেখি আমার চেয়েও কঠিন লড়াই কোটি কোটি মানুষ করে চলেছে। লকডাউন পর্যায়ে শ্রমিকদের যে ভয়ঙ্কর দুর্দশা গেছে, তা দেখে তখন ব্যথিত হতাম তাদের দুরাবস্থা দেখে। সামাজিকভাবে তারা কিছু সাহায্য পেলেও সরকারি তরফে আরও অনেক বেশি তাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত ছিল বলে মনে করি। তো শুধু এই করোনা পর্যায়েই নয় চিরকালই এক বৃহৎ শ্রেণির মানুষ ভয়ঙ্করতম লড়াই করে চলেছে শুধুমাত্র বেঁচে থাকার তাগিদে। তাদের কাছে নিজের লড়াই খুবই সামান্যই।

তবুও আমার মতো করে কিছু বলতে পারি। পুরস্কার পাব বলে তো আমি স্প্যানিশ ভাষা শুরু করিনি। আমার একটা অসফল দাম্পত্য জীবন ছিল। এবং সেটার পরে এটা খুব ভয়ঙ্করভাবেই তার পরিণতির দিকে যায়। একদিন রাতে আমার সন্তানের বাবা বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। তার আগের ইতিহাসও খুব রক্তাক্ত ছিল। তারপরেও ভয়ঙ্কর লড়াইয়ের দিকে যেতে হয়েছে। দুমুঠো ভাত পাওয়ার জন্য। আমার সমস্যাটা আলাদা ছিল। ছেলে ও আমার দুজনের খাওয়াটাই শুধু লড়াই ছিল না। তখন আমি সদ্য স্প্যানিশ ভাষা শিখতে ভর্তি হয়েছিলাম গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ ল্যাঙ্গুয়েজে। যেহেতু ওটা চ্যারিটেবল ইন্সস্টিটিউট তাই ফিজ খুব কম ছিল। সেই কারণেই পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতে পরেছি। সেই ফিজ দেওয়ার ক্ষমতাও ছিল না। প্রায় কপর্দক শূন্য ছিলাম। সেই অবস্থায় কী করে চালিয়েছি এখন তাই ভাবলেও অবাক লাগে। দু মুঠো খেয়ে দিন রাত শুধু স্প্যানিশ নিয়ে পড়ে গেছি। সেই সময় টাকার দরকার ছিল কারণ তিনটি মামলা ছিল। ছেলে তখন স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা দেবে। সেই অবস্থায় তার মনের উপর সাংঘাতিক একটা আঘাত আসে। সংসারের তছনছ অবস্থা। নিজের আঘাতের কথা তখন আর ভাবার সমই পাইনি। ছেলেকে সামলানো, খাবার জোগাড় করা, উকিলকে ফিজ দেওয়া। মামলার খুঁটিনাটি দেখতে হত। নিজের সপক্ষে সত্যতা প্রমাণের জন্য মাথা ঘামিয়ে উকিলকে সব সাজিয়ে গুছিয়ে দিতে হত। তো আমি তখন স্প্যানিশ পড়ছি মাত্র দু তিন মাস পড়া শুরু করেছিলাম, ছেড়ে দিইনি এই কারণে, যে আমার নিজের উপর ধিক্কার লেগেছিল। কস্ট অ্যাকাউটেন্সি অর্ধেক পথ ক্লিয়ার করে প্রিলিমিনারি পাসের পর ফাইনালের দু মাসের আগে বিয়ে করে ফেলি। কারণ আমি একটা রিলেশনশিপে ছিলাম। কিন্তু বিয়ের পর ১৬ বছরের গ্যাপ পড়ে গিয়েছিল। তাই নিজের মনুষ্যত্বে ধিক্কার এসেছিল তাই স্প্যানিশটা ছাড়তে পারিনি।

এজন্য আমার শিক্ষকেরা ভীষণ সাহায্য করেছেন। আমার প্রথম শিক্ষক ম্যাডাম শীলা চক্রবর্তী অনেক দিনই বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়ে পড়াতেন, খাইয়েও দিতেন। প্রয়াত সুব্রত স্যার আগে বিনা পয়সায় পড়ান শুনে তাঁর বাড়িতে গিয়েও পড়ে এসেছি। যেহেতু হাতে টাকা ছিল না তাই যখন যেখানে সুযোগ ছিল সেখানে গিয়ে বিষয়টা বুঝে নিতাম। আমার মনে হত অন্যরা যেটা ৩ বছরে করবে, যেহেতু আমার ১৬টা বছর নষ্ট হয়ে গিয়েছিল মনে হয়েছিল নিজেকে আমি ঠকিয়েছি, ফাঁকি দিয়েছি। তাই আমাকে সেটা আরও কম সময়ের মধ্যে পূরণ করতে হবে। এতটাই জেদ চেপে গিয়েছিল যে দিনে মাত্র ২-১ ঘণ্টা ঘুমোতাম। সারাক্ষণ কাজ করতে হত। বাড়ি, কোর্ট, পড়াশোনা সমানে চলত। লড়াই সবাই করে। নিজেকে আমি মহৎ বলতে চাই না। এটুকু বলতে চাই, যে সবচেয়ে জরুরি যেটা সেটা হল, যদি ভুল বুঝতে পারি যে, যে অভিশাপ জীবনে নেমে এসেছে তার পিছনে আমারও কিছু দায়ভার আছে সেটা যখন মানুষ বুঝতে পারে তখন সে তার সর্বস্ব দিয়েই চেষ্টা করে, আমিও সেভাবেই করেছি।

৩) ট্রান্সলেশনকে পেশা হিসেবে বেছে নিলেন কীভাবে ?

জয়া চৌধুরী (ফাইল ফোটো)
জয়া চৌধুরী (ফাইল ফোটো)

অনুবাদকে প্রথমেই পেশা হিসেবে বেছে নিইনি। প্রথমে অধ্যাপনাকে পেশা হিসেবে বেছে নিই। তার জন্য এই ভাষাকে বেছে নিই। টিউশন শুরু করেছিলাম প্রথম। আর যেহেতু আমি মাদ্রিদ থেকে স্প্যানিশে ডিপ্লোমা নিয়েছিলাম। তাই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ানোর সুযোগ দিয়েছে আমাকে। তাই অনুবাদের আগে শিক্ষকতাই আমার পেশা। পাশাপাশি লিটারেচার যেহেতু আমার প্রাণ। তাই সেইসঙ্গে অনুবাদও চলে।

৪) এক্ষেত্রে কেরিয়ার গড়ার সুযোগ কতটা ?

জয়া চৌধুরী (ফাইল ফোটো)
লীলা রায় পুরস্কার গ্রহণ করছেন জয়া চৌধুরী।

অনুবাদ করে কেরিয়ার গড়ার ভালোই সুযোগ আছে। এখন অনেকেই মিনিমাম ডিপ্লোমা নিয়ে কখন রোজগার করব সেই প্রবণতাটা বেশি দেখা যায়। কিন্তু কেরিয়ার গড়ার জন্য ছন্দবদ্ধভাবে কোয়ালিফিকেশন করে চাকরি পেতে ১৬-১৮ বছর সময় লেগে যায়। অথচ কেউ যখন একটা বিদেশি ভাষা শেখে তখন সে ২-৩ বছরের মধ্যেই এটাকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে চায়। এটার সঙ্গে বাস্তবের কোনও সম্পর্ক নেই। এটা কাল্পনিক। তাই কেউ এটাকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে চাইলে তাকে বুঝতে হবে যে তারা অনেক দেরিতে বিদেশি ভাষা শিখতে শুরু করছেন। তাঁদের তার জন্য সেরকম পরিশ্রমটাও জরুরি। যোগ্যতা থাকলে ঠিক কেরিয়ার হয়ে যাবে। দোভাষীর কাজের সুযোগ প্রচুর আছে। কিন্তু যোগ্যতাটা তার জন্য বাড়িয়ে যেতে হবে। প্রচুর সিরিয়াসলি নিতে হবে বিষয়টিকে। তবেই সম্ভব হবে।

৫) ভাষা শিক্ষা নিয়ে আধুনিক প্রজন্ম কতটা আগ্রহী বলে আপনার মনে হয় ?

ভাশা শিক্ষা নিয়ে আধুনিক প্রজন্ম অত্যন্ত আগ্রহী। আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা বলে বাবা মায়েরাও খুব উৎসাহী। অনেকেই ছেলেমেয়েকে একটা আলাদা ভাষা শেখাতে চান। ঋষি অরবিন্দ প্রবর্তিত যে শিক্ষা ব্যবস্থা সেটা যারা ফলে করে সেই সব সেন্টারে দেখা যায় শৈশব থেকেই ৪-৫ টা ভাষা হয়তো ১-২ বছর বয়স থেকেই শুরু করে দিচ্ছে। সেই মতাদর্শ থেকে শৈশব থেকেই অনেক ভাষা শেখানো শুরু করা গেলে অনেকে দিক থেকেই উপকার হয় ছেলে মেয়েদের। সেদিক থেকে ভাষা শিক্ষার উপকারিতা তো আছেই। আগ্রহ যদি বলেন বাস্তব বোধ থেকে তরুণ প্রজন্মের অনেকেই আগ্রহী ভাষা শিখতে বাবা মায়েরাও তাই চান, এটা অনেকটাই পজিটিভ।

৬) নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের জন্য আপনার বার্তা

নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের জন্য আমার একটাই অনুরোধ থাকবে, ভাষা শিখতে হলে অবশ্যই মনের দুয়ার খুলে রাখতে হবে। নিজের পূর্ব নির্ধারিত একটা ধারণা নিয়ে ভাষা শিখতে আসা সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি নয়। প্রথমত ভাষা শেখা মানে সেটা যে দেশের ভাষা সে দেশের সংস্কৃতি অর্থনীতৈক অবস্থা সবটার একটা এরিয়াল নলেজ রাখা দরকার। তা না হলে আপনি যে ভাষা শিখছেন সেই ভাষা ভিত্তিক চাকরি পেতে চাইলে তাহলে সেই ভাষা কোন দেশে বলে সেই দেশ কী কী ব্যবসায়ীক বা সাহিত্যিক কাজ করছে তা নিয়ে নলেজ না থাকলে আপনি কাজের জন্য অ্যাপ্রোচ করতে পারবেন না। আপনি বলতে পারবেন না যে এই ভাষাটা জানি আমাকে কাজে লাগান। তাই শুধু পুঁথিগত বিদ্যে নয়। এর বাইরেও অনেক জ্ঞান আহরন করতে হবে। ভাষা কোনও সমাজ বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়। সেই সমাজটা চিনতে হবে। এটা করতে করতেই একটা পথ বেরিয়ে আসবে। নতুন প্রজন্ম এনিয়ে অনেকটাই সচেতন, উদ্যোগী, সিরিয়াস, রিস্ক নিতে চায়। তাই তারা যদি ভাষা নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবনা চিন্তা করে তাহলে আগামী ১০ বছরের মধ্যে এখনকার চিত্রটা অনেকটাই উন্নত হবে বলেই আমার ধারনা।

৭) এই মুহূর্তে কী নিয়ে ব্যস্ত ?

আমি তো সাহিত্য নিয়ে অনুবাদের কাজ করি। এখন আমি একটি উপন্যাস নিয়ে ব্যস্ত। সদ্য শেষ করেছি একটি উরুগুয়ে ও মেক্সিকোর একটি উপন্যাস নিয়ে। এবং অ্যান্থোলজি নিয়ে দুটি বইয়ের কাজ চলছে এই মুহূর্তে। এছাড়া প্রতি মাসেই চাহিদা মতো বিভিন্ন অনুবাদের কাজ হাতে আসে।

৮) ভবিষ্যতে কী কী কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে ?

ভবিষ্যৎ নিয়ে কী করে বলব (হেসে) । আমি ঠিক অত ভবিষ্যৎ ভাবতে পারি না। বর্তমান সামলাতে সামলাতেই সময় চলে যায়। তবে একটা পরিকল্পনা সব সময়ই থাকে। ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা (Federico García Lorca), অক্তাভিও পাস (Octavio Paz), গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস (Gabriel García Márquez), পাবলো নেরুদা (Pablo Neruda) এই সমস্ত নামগুলো বাঙালি পাঠক ভালোভাবেই চেনেন। এছাড়া খাভিয়ের সেরকাস ( Javier Cercas), মারিও ভার্গাস ইয়োসা ( Mario Vargas Llosa) সহ আরও অনেক সাহিত্যিক আছেন। তাই আরও বেশ কিছু মহৎ সাহিত্যকে চেষ্টা করব বাংলা ভাষায় নিয়ে আসতে।

Share it