Pandemic
Share it

কবিতা মুখোপাধ্যায় (শিক্ষাপ্রেমী): “…মহা আশঙ্কা জপিছে মৌন মন্তরে,/ দিক্-দিগন্ত অবগুণ্ঠনে ঢাকা -/ তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,/ এখনি, অন্ধ, বন্ধ করো না পাখা।।…”

হ্যাঁ, মহা-আশঙ্কায় গোটা বিশ্ব কাঁপছে। কেউ জানে না কোথায় তার পরিসমাপ্তি ঘটবে। বর্তমান পৃথিবীর মানুষ শুনে এসেছে বেশ কয়েকটা অতিমারীর কথা, কিন্তু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা কোভিড-১৯-এর সর্বব্যাপী আক্রমণের ফলে অপ্রস্তুত বিশ্বের মানুষ দিশেহারা হয়ে গৃহবন্দী হলেন। ছত্র-ভঙ্গ অতি উন্নত মানব সভ্যতা। একটা ছোট্ট ভাইরাসের প্রভাবে ‘আমি ঈশ্বর’-এর ধারণা পদানত। আর এই অতিমারীর আক্রমণের ক্ষমতাকে সঠিক মূল্যায়ণ করতে না পেরে ভারতবর্ষের ‘না মুমকিন’ ভাবনা একেবারে ভেঙ্গে দিল ভারতের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডকে।

সতর্কবার্তা থাকা সত্বেও আমরা মেতে থেকেছি বাইরের বন্ধুর জন্য রাজকীয় অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে। সংক্রমণ যখন দ্রুত বিস্তার লাভ করছে তখনও আমরা বাইরে থেকে ডেকে এনেছি বহু মানুষকে, কোনও বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না করে। বরং আমরা চাইলাম থালা বাজিয়ে, দিয়া জ্বালিয়ে করোনার বিদায়ঘণ্টা বাজিয়ে দিতে। করোনা লাগামছাড়া হতেই অ-পরিকল্পিতভাবে দেশজুড়ে লকডাউন ঘোষণা করেছিলাম। অর্থব্যবস্থা ভেঙে চুরমার, অসহায় পরিযায়ী শ্রমিকদের খাদ্যহীন, অর্থহীন, কর্মহীন জীবন থেকে মুক্তির আশায় দীর্ঘ পদযাত্রা এবং মৃত্যুর কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ। যত না মানুষ মারা গেল করোনায় তার চেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটলো অর্ধাহারে, অনাহারে অর্থনীতিবিদ থেকে বিরোধী রাজনৈতিক দলের মানুষ জন, বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা সহ শুভবুদ্ধি বোধসম্পন্ন বহু মানুষের আবেদনেও পাথর প্রতিম দেশের কেন্দ্র সরকার শুধু নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য রয়ে গেলেন উত্তরহীন ক্রিয়াহীন এবং সমস্ত দায়কে লজ্জাহীন ভাবে চাপিয়ে দেওয়া হলো রাজ্যগুলির কাঁধে।

আবার শুরু হল করোনা জয়ের ঢঙ্কানিনাদ, অতিমারীকে করেছি পরাজিত। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের ঘোষণা ছিল দ্বিতীয়, তৃতীয় ঢেউ-এর। না, আমরা মানিনি ‘কুম্ভ’ ৮ দফায় নির্বাচন! – শুধু রাজনৈতিক লাভের অঙ্ক আর তার ফলশ্রুতি আছড়ে পড়ল বহু শক্তিশালী দ্বিতীয় ঢেউ এবং তৃতীয় ঢেউ দরজায় কড়া নাড়ছে। একটি গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচিত সরকারের ভূমিকা যে এরকম হতে পারে তা দেশের মানুষের ভাবনার অতীত ছিল। আর এই টালমাটাল অবস্থায় অর্থনীতির মেরুদণ্ডের সঙ্গে সঙ্গে আরও একটি মেরুদণ্ডকে ভেঙে দেওয়া হচ্ছে সচেতনভাবে সেটি হল শিক্ষা বা মেধা চর্চার ক্ষেত্রকে।

অতিমারীর শুরু থেকে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। অনলাইনে পঠন-পাঠনের কিছুটা কাজ চলছে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে, কিন্তু প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রায় স্তব্ধ হয়ে আছে বিশেষত গ্রামাঞ্চলে। যেখানে অতি সাধারণ পরিবারের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য এক কথায় বলা চলে শিক্ষার দরজা বন্ধ। প্রায় দু’বছর এই সমস্ত সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের কাছে প্রথাগত শিক্ষার আলো পৌঁছান যাচ্ছে না।

এই অবস্থা থেকে উত্তরণ ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে। কিন্তু এভাবে আর কতদিন চলবে ? বন্ধ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে সদর্থক কিছু ভাবনা আমরা কি এখনও ভেবে উঠতে পারব না ?

শিক্ষক সমাজ থেকে শুরু করে শিক্ষাবিদরা, অভিভাবক সমাজ সবাই উদ্বিগ্ন ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। কিন্তু অতিমারীর এই সময়কালে কোনও সদর্থক ভাবনা কেন আমরা ভেবে উঠতে পারলাম না ? এই অতিমারীর যদি চলে আগামীতে তখনও কি আমরা সিদ্ধান্ত নেব স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখার ? সব পরীক্ষা বাতিল করার ? নাকি সচেষ্ট হব আন্তরিকভাবেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ দরজাগুলিকে উন্মুক্ত করার ? আমরা তো এভাবে ভাবতে পারি – এক, প্রতিটি স্কুলের সময় নির্দিষ্ট হোক সকাল ৯’টা থেকে বিকেল ৫টা এবং স্কুল হোক ৭দিনই। প্রত্যেক স্তরের শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মীদের সপ্তাহের একদিন ছুটি দিয়ে, প্রয়োজনে স্থানীয় অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-শিক্ষিকা, শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতী এবং স্বেচ্ছায় শ্রমদানে উৎসাহী শিক্ষিত সমাজের সাহায্য নিয়ে প্রতিদিন, প্রতিটি ক্লাসকে ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ করে ক্লাসের ব্যবস্থা করা। এই ক্লাসগুলিতে ছাত্রছাত্রী শিক্ষক শিক্ষিকারা যারা ১৫-১৬ কিলোমিটারের মধ্যে থাকেন তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট সময় ধরে বাস চালু করা হোক যাতায়াতের সুবিধা এবং সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষার জন্য। সরকারের পক্ষ থেকে বাসগুলিকে যেমন কিছুটা ভর্তুকি দেবার ব্যবস্থা করতে হবে সঙ্গে সঙ্গে নির্দিষ্ট বাসের আরোহীদের বাস ভাড়া দিতে হবে ছাত্রছাত্রীরা পাবে কনসেশন। নির্দিষ্ট স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকাদের বাইরে যাদের সাহায্য নেওয়া হবে তাদের জন্য কিছুটা সম্মান দক্ষিণার ব্যবস্থা করতে হবে। যারা স্বেচ্ছাশ্রম দেবেন তাঁরা অবশ্য ব্যতিক্রম। ভাবনা ২, প্রতিটি স্কুলকে নিয়মিত সংক্রমণমুক্ত রাখার দায়িত্ব নিতে হবে শহরে পৌরসভাকে গ্রামে পঞ্চায়েতকে।

প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক এর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ কোথা থেকে আসবে ? অতিমারীর এ সময়ে বহু মানুষ কোটি কোটি টাকা দান করেছেন ‘পিএম কেয়ার্স ফান্ডে। দেশের ভবিষ্যৎ মেরুদন্ডকে ঠিক রাখতে অর্থনীতিকে সঠিক দিশায় নিয়ে যাবার ক্ষেত্রে যেমন অর্থনীতিবিদদের প্রদর্শিত পথে চলতে হবে, পাশাপাশি ভবিষ্যৎ দেশের মেরুদন্ডকে শক্ত রাখার প্রয়োজনে শিক্ষার জন্য এ ব্যয় করতেই হবে। স্থানীয়ভাবেও শিক্ষার জন্য সরকার কোনও ফান্ড গড়তে পারেন যা স্থানীয় স্কুলের জন্যই ব্যয়িত করতে হবে। শিক্ষা রয়েছে যৌথ তালিকায় দ্রুত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে চালু করার জন্য প্রয়োজন কেন্দ্র-রাজ্যের যৌথ প্রয়াস। আর ছাত্র-ছাত্রীদের সুরক্ষার জন্য প্রয়োজন দ্রুত ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা করা – এক্ষেত্রে কোনও রাজনীতি নয়। এখনই যদি সদর্থক ও সক্রিয় ব্যবস্থা না নেওয়া যায় তবে বহু দেরি হয়ে যাবে। অতিমারী একদিন বিদায় নেবেই, সেই ভবিষ্যৎ কালে ইতিহাস কিন্তু আমাদের ছাড়বে না। শিক্ষার মুক্ত বিহঙ্গ-কে তার পাখা বন্ধ করতে দেব না – এ প্রতিজ্ঞা আমাদের করতেই হবে, নতুবা নেমে আসবে অন্ধকার।

Share it