Bela Bose to Tumpa Sona
Share it

ডঃ সৌমেন চক্রবর্তী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক, সাধনচন্দ্র মহাবিদ্যালয় (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়): এই রচনার শিরোনামের তাৎপর্য সূত্র ধরেই বিষয় বস্তুর ডাল-পালা প্রসারিত। প্রথমেই বলে নেওয়া ভাল শিরোনামের শুরু থেকে শেষ – নির্দিষ্ট একটা সময়ান্তর যুব প্রজন্মের ছবি ধরা দেয় বলে আমার বিশ্বাস। তার সাথে সাথে সমাজ রাজনীতির সম্পর্কের বন্ধনে ক্ষমতা অর্জনের বর্গ ও পরিবর্তন হওয়ার দিকটিও ধরা দেয়।

সময়ান্তরের জনপ্রিয় গানে – বেলা বোস – নীলাঞ্জনা – টুম্পা সোনা, বিগত ১৯৯০-এর দশক থেকে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত সময়কালকে চিহ্নিত করে নিয়ে আলোচনাকে এগিয়ে নিয়ে যাব। বাঙালি আবেগপ্রবণ, সৃষ্টিশীল – একথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ১৯৯০-এর দশক আমাদের কাছে চিহ্নিত হয়ে আছে উদারীকরণ – বিশ্বায়ন- বেসরকারিকরণের আর্থ সামাজিক – রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণের যুগ। বাম বাংলায় আমরা দেখেছি মহানগরের দেওয়াল থেকে আদিবাসী রমণীর মাটির দেওয়ালে কাঁচা হাতের লেখায় বিশ্বায়ন বিরোধী বাম স্লোগানের ধারালো প্রচার। ব্রিগেডের সভা গরম – ‘প্রতিবাদে প্রতিরোধে কমরেড, গড়ে তোলো ব্যারিকেড’ । তখনও মঞ্চে মঞ্চে অজিত পান্ডের – চাষনালার খনির বিপর্যয়ের গান বাজত, বাজত ক্যালকাটা কয়্যারের ‘বিস্তীর্ণ নদীপারের’ গান অথবা কিছুটা ধুষর হয়ে যাওয়া হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ‘শঙ্খচিল’, ‘জন হেনরি’, ‘ওরা আমাদের গান গাইতে দেয় না’, ইত্যাদি। কিন্তু, সেই সময়কার জীবন যন্ত্রণার প্রকাশ কোথায় যেন মহানগরের শিক্ষিত বেকার যুবকদের ধরতে ব্যর্থ হল। সেখান থেকে আত্মপ্রকাশ করল অঞ্জন দত্তের গাওয়া “বেলা বোস’। সে হয়ে উঠল একান্নবর্তী পরিবারের ভেঙে যাওয়া যন্ত্রণা, আবার উদীয়মান বেনিয়া শ্রেণির নব্য আভিজাত্যের গরাদ ভেঙে প্রেমিকাকে নিয়ে শহরতলি “কসবা’-তে ছোট ফ্ল্যাট কিনে সুখী সংসার গড়ে নেওয়ার যুবকের প্রথম প্রস্তুতি। “কেরানি কুলের’ অবসান ঘটতে চলেছে – বেসরকারি সংস্থার চাকরি করেই জীবন নির্বাহ করার নিদান জারি হয়েছে। চাকরির কোন স্থায়ী নিশ্চয়তা নেই এখানে। যুবক মন মানা-নামানোর দ্বন্দে বিভাজিত। বাংলার রাজনৈতিক আধিপত্যে যদিও তখন এই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি সম্প্রদায়ের হাতে। সেই যুব সমাজকে যেন প্রতিনিধিত্ব করছে প্রেমিকা বেলা বোস। বাংলার এই সময়েই লোকচক্ষুর অন্তরালে “দল সমাজের’ আধিপত্যের আঁতুর ঘরে জন্ম নিল “ত্রিফলা বেনিয়া রাজ’। এই ত্রিফলার একটা ফলায় ইঁটভাটার মালিক, আর একটা ফলায় ভেরি মালিক, এবং নির্মাণ কাজে লিপ্ত জমি হাঙ্গর প্রোমোটার।

শহরতলীর উদ্বাস্তু অধ্যুষিত উত্তরের দমদম-বেলঘরিয়া থেকে দক্ষিণের যাদবপুর -সন্তোষপুর-গড়িয়া পর্যন্ত নব্য বেনিয়া প্রোমোটার বা বাজার চলতি কথায় ‘ডেভেলপার’। স্থানীয় অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণের সাথে সাথে স্থানীয় রাজনীতির সাথে গাঁটছড়া বাঁধল। শহরতলীর রকে বসা বেকার যুবকদের মনের কথাকে প্রতিষ্ঠিত করলো নচিকেতার “নীলাঞ্জনা’। চাকরি নেই, কিন্তু ক্ষমতার আধিপত্যের বৃত্তে থাকা বছর বছর যুব সম্মেলন, মহিলা সম্মেলন, অটো রিকশা চালকদের সম্মেলন, ইত্যাদি, ইত্যাদিতে যোগদান না করলে স্থানীয় নেতাদের রোষানলে পড়তে হবে, আবার পার্ট টাইম পকেটমানি হিসাবে আসা ‘সেমি-ডেভেলপারদের’ প্রজেক্টে ইঁট-বালি-পাথর-সিমেন্ট সাপ্লাইটা বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু এসবের মধ্যেও বাঙালি আবেগের প্রেমে মাঝারিয়ানার শিক্ষিত শহরতলীর বিরাটসংখ্যক যুবকদের মনের আঙিনায় নিজের করে জায়গা করে নিল “নীলাঞ্জনা”।

এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো – নীলাঞ্জনার মধ্যে দিয়ে নিষ্ক্রিয় বিপ্লবের পথ প্রসারিত হল। পাড়ায় পাড়ায় রাস্তার ঠেক বা রক থেকে মেট্রোপলিটন মধ্যবিত্ত বাঙালি যুবক আর প্রেমিকাদের হাতে বাতিল তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে চাইল না। বেলা বোস-এর সময়ের মার্জিত ভদ্রতার সাথে কাতর আহ্বান না করে সে ফেটে উঠল এই “দল–সমাজ’ আর ব্রিগেডের শীতকালীন মিঠেল রোদে নেতাদের গালভরা প্রতিশ্রুতিতে চিরে ভেজাতে রাজি নয়। ইতিমধ্যে “ডান্ডা-ঝান্ডা-ধান্দা’ যমজ ভাই-বোন হয়ে গেছে পশ্চিম বাংলায়। যুব সমাজ বিদ্রোহ ঘোষণা করল কার্যত মাঝারি মেধায় বলিয়ান বাম ভাবাপন্ন সুবিধাভোগী মধ্যবিত্তের আধিপত্যের শৃঙ্খলের বিরুদ্ধে। জন্ম নিল এক নতুন রাজনৈতিক-সামাজিক আধিপত্য বলয়। একে ঠিক দক্ষিণপন্থী শুদ্ধতার সাথে রাখা যায় না। একটা নতুন সমীকরণ। ক্ষমতা চলে গেল কার্যত নিম্নবর্গীয় জননেতার হাতে। যারা ভোট জোর করার রাজনীতিতে ব্যবহার করতে শুরু করল ধর্ম, জাত-পাত, জনগোষ্ঠীর আত্ম পরিচিতি – যা সার্বিকভাবে জোরদার করল শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গির বদলে ‘আত্মপরিচিতির রাজনীতিকে’।

আর তাই ২১শের পশ্চিমবাংলাদের আগামী পাঁচ বছরে শাসনভার নির্ধারণের সময়কালে যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি আমরা দেখছি, সেখানে মহানগর ব্রাত্য। গ্রাম বাংলা ও ‘সেমি আরবান সোসাইটি’তে ভোট জড়ো করার রাজনীতিতে মাতোয়ারা “টুম্পাসোনা’ গানের কলিতে কোমর দোলানোর যুব সম্প্রদায়। কারণ, তাদের স্বপ্নের স্বাচ্ছন্দের ঘরে “টুম্পাসোনা’ জীবনযাত্রার জীবনসঙ্গী। মেট্রোপলিটন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মন তাকে যতই তিরস্কার করুক, ‘টুম্পা সোনা’ প্রজন্ম শুধু আর ভোট দিতে চায় না, ভোট জড়ো করতে চায় না, তাঁরা চায় রাজনীতিতে ক্ষমতার অংশীদারিত্ব।

Share it